পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কিন্তু জনার্দন রায় অত সহজে ভুল করবার লোক নহেন; প্রত্যুত্তরে তিনি শিরোমণির প্রতি একটা রুদ্ধদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন, হুজুর যখন নিজে শুনতে চাচ্ছেন তখন আর ভয় কি ঠাকুর? নির্ভয়ে জানিয়ে দিন না।

 খোঁচা খাইয়া বৃদ্ধ শিরোমণি হঠাৎ ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, সত্যি কথায় ভয় কিসের জনার্দন? তারাদাসের মেয়েকে আর আমরা কেউ ভৈরবী রাখব না হুজুর! তার স্বভাব-চরিত্র ভারী মন্দ হয়ে গেছে―এই আপনাকে আমরা জানিয়ে দিচ্চি।

 জীবানন্দের পরিহাস-দীপ্ত প্রফুল্ল মুখ অকস্মাৎ গম্ভীর ও কঠিন হইয়া উঠিল; একমুহূর্ত নিঃশব্দে থাকিয়া ধীরে ধীরে প্রশ্ন করিলেন, তাঁর স্বভাব-চরিত্র মন্দ হবার খবর আপনারা নিশ্চয় জেনেছেন?

 তৎক্ষণাৎ অনেকে একবাক্যে বলিয়া উঠিল যে, ইহাতে কাহারও কোন সংশয় নাই―এ গ্রামসুদ্ধ সবাই জানিয়াছে। জনার্দন মুখে কিছু না কহিলেও চুপ করিয়া মাথা নাড়িতে লাগিলেন। জীবানন্দ আবার ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া তাঁহারই মুখের প্রতি চাহিয়া কহিলেন, তাই সুবিচারের আশায় বেছে বেছে একেবারে ভীষ্মদেবের কাছে এসে পড়েছেন রায়মহাশয়? বিশেষ সুবিধে হবে বলে ভরসা হয় না।

 এ কথার ইঙ্গিত সকলে বুঝিল কিনা সন্দেহ, কিন্তু জনার্দন এবং শিরোমণি বুঝিলেন। জনার্দন মৌন হইয়া রহিলেন, কিন্তু শিরোমণি জবাব দিলেন। বলিলেন, আপনি দেশের রাজা―সুবিচার বলুন, অবিচার বলুন, আপনাকেই করতে হবে। আমাদের তাই মাথা পেতে নিতে হবে। সমস্ত চণ্ডীগড় ত আপনারই।

 কথা শুনিয়া জীবানন্দের মুখের ভাব একটু সহজ হইয়া আসিল; মুচকিয়া হাসিয়া কহিলেন, দেখুন শিরোমণিমশাই, অতি-বিনয়ে আপনাদের খুব হেঁট হয়ে কাজ নেই, অতি-গৌরবে আমাকেও আকাশে তোলবার আবশ্যক নেই। আমি শুধু জানতে চাই, এ অভিযোগ কি সত্য?

 সাগ্রহে রায়মহাশয়ের মুখ আশান্বিত হইয়া উঠিল। শিরোমণি ত একেবারে চঞ্চল হইয়া উঠিলেন; কহিলেন, অভিযোেগ? সত্য কি না! আচ্ছা, আমরা না হয়, কিন্তু তারাদাস, তুমিই বল ত! রাজদ্বার! যথাধর্ম বলো―

 তারাদাস একবার পাংশু, এবার রাঙ্গা হইয়া উঠিতে লাগিল, কিন্তু উপস্থিত সকলের একাগ্র দৃষ্টি খোঁচা দিয়া যেন তাহাকে উত্তেজিত করিতে লাগিল। সে একবার ঢোক গিলিয়া, একবার কণ্ঠের জড়তা সাফ করিয়া অবশেষে মরিয়ার মত বলিয়া উঠিল, হুজুর―

 জীবানন্দ চক্ষের নিমেষে হাত তুলিয়া তাহাকে থামাইয়া দিয়া কহিলেন, থাক। ওর মুখ থেকে ওর নিজের মেয়ের কাহিনী আমি যথাধর্ম বললেও শুনব না। বরঞ্চ আপনাদের কেউ পারেন ত যথাধর্ম বলুন।

 সভা পুনশ্চ নীরব হইল, কিন্তু এবার সে নীরবতার মধ্য হইতে অস্ফুট উদ্যম পরিস্ফুট হইবার লক্ষণ দেখা দিল। পাশের দরজা খুলিয়া বেহারা টম্‌ব্লার ভরিয়া হুইস্কি ও সোডা প্রভুর হাতে আনিয়া দিল; তিনি এক নিঃশ্বাসে তাহা নিঃশেষে পান

৮১

 দেঃ পাঃ―৬