পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দিয়ে যাচ্চি, কালই এ-সব হতে হবে এবং হওয়াই চাই।

 জোর করে?

 হাঁ, জোর করে।

 সুবিধে-অসুবিধে যাই-ই হোক?

 হাঁ, সুবিধে-অসুবিধে যাই হোক।

 ষোড়শী আর কোন তর্ক করিল না। পিছনে চাহিয়া ভিড়ের মধ্যে একজনকে অঙ্গুলি-সঙ্কেতে আহ্বান করিয়া, সাগর, তোদের সমস্ত ঠিক আছে?

 সাগর সবিনয়ে কহিল, আছে মা, তোমার আশীর্বাদে অভাব কিছুই নেই।

 ষোড়শী কহিল, বেশ। জমিদারের লোক কাল একটা হাঙ্গামা বাধাতে চায়, কিন্তু আমি তা চাইনে। এই গাজনের সময়টা রক্তপাত হয় আমার ইচ্ছে নয়, কিন্তু দরকার হলে করতেই হবে। এই লোকগুলো তোরা দেখে রাখ; এদের কেউ যেন আমার মন্দিরের ত্রিসীমানায় না আসতে পারে। হঠাৎ মারিস নে―শুধু গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিবি। এই বলিয়া সে আর দৃক্‌পাতমাত্র না করিয়া মন্দপদে বারান্দা পার হইয়া গেল। ষোড়শীকে বিশ বছর ধরিয়া লোকে দেখিয়া আসিয়াছে, তাহাকে জানিবার যে কিছু বাকী আছে কেহ মনেও করে নাই। কিন্তু আজ তাহার প্রকৃতির এই অসাধারণ দিকটার প্রথম পরিচয় পাইয়া হুজুর হইতে পেয়াদা পর্যন্ত যেন পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হইয়া রহিল।

ষোল

 চৈত্রের সংক্রান্তি নিরুপদ্রবে কাটিয়া গেল―‘শিব-শম্ভুর’ গাজন-উৎসবে কোথাও কিছুমাত্র বিঘ্ন ঘটিল না। দর্শকের দল ঘরে ফিরিল, দোকানীরা দোকান ভাঙ্গিতে প্রবৃত্ত হইল, বাতাসে তেলে-ভাজা খাবারের গন্ধ ফিকা হইয়া আসিল, এবং গেরুয়াধারীরাও চীৎকার ছাড়িয়া গৃহকর্মে মন দিবার প্রয়োজন অনুভব করিল। চিরদিনের অভ্যস্ত সুরে চারিদিকের আবহাওয়ায় সুখ-দুঃখের আবার সেই পরিচিত স্রোত দেখা দিল, কেবল চণ্ডীগড়ের ভৈরবীর দেহের মধ্যে কি যে রোগ প্রবেশ করিল তাহার সে চেহারা আর ফিরিয়া আসিল না―কি একপ্রকার ভয়ে ভয়ে মন যেন তাহার অহর্নিশি চকিত হইয়াই রহিল। উৎসবের কয়টা দিন যেন নির্বিঘ্নে কাটাই সম্ভব এ আশা ষোড়শীর ছিল, কারণ দেবতার ক্রোধোদ্রেকের দায়িত্ব আর যে-কেহ মাথায় করিতে চা'ক জনার্দন চাহিবে না সে নিশ্চিত জানিত। কিন্তু এইবার?

 তুবও দিনগুলা এমনি নিঃশব্দে কাটিতে লাগিল যেন আর কোন হাঙ্গামা নাই, সমস্ত মিটিয়া গেছে। কিন্তু সত্য সত্যই মিটিয়া যে কিছু যায় নাই, অলক্ষ্যে গোপনে কঠিন কিছু একটা দানা বাঁধিয়া উঠিতেছে এ আশঙ্কা শুধু ষোড়শীর নহে, মনে মনে

৯৪