পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দেবদাস
২১

কিছুক্ষণ দেবদাসের সহিত কথা কহিল না; কিন্তু শেষে যখন দেবদাস ডাকিয়া বলিল, পারু আবার শিগগির আসব; যদি না পাঠিয়ে দেয় তো পালিয়ে আসব।

 তখন পার্ব্বতী প্রকৃতিস্থা হইয়া নিজের ক্ষুদ্র হৃদয়ের অনেক কথা কহিয়া শুনাইল। তাহার পর সে ঘোড়ার গাড়ি চড়িয়া, পোর্টমাণ্টো লইয়া, জননীর আশীর্বাদ ও চক্ষের জলের শেষ বিন্দুটি কপালে টিপের মতো পরিয়া দেবদাস চলিয়া গেল।

 তখন পার্ব্বতীর কত কষ্ট হইল; কত চোখের জলের ধারা গাল বহিয়া নীচে পড়িতে লাগিল; কত অভিমানে তাহার বুক ফাটিতে লাগিল। প্রথম কয়েক দিন তাহার এইরূপে কাটিল। তাহার পর হঠাৎ একদিন প্রাতঃকালে উঠিয়া দেখিতে পাইল, সমস্তদিনের জন্য তাহার কিছুই করিবার নাই। ইতিপূর্বে পাঠশালা ছাড়িয়া অবধি প্রাতঃকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুধু গোলমালে, হুজুগে কাটিয়া যাইত; কত কি যেন তাহার করিবার আছে,—শুধু সময়ে কুলাইয়া উঠে না। এখন অনেক সময়, কিন্তু এতটুকু কাজ খুঁজিয়া পায় না। সকালবেলা উঠিয়া কোনদিন চিঠি লিখিতে বসে। বেলা দশটা বাজিয়া যায়, জননী বিরক্ত হইয়া উঠেন; পিতামহী শুনিয়া বলেন, আহা, তা লিখুক। সকালবেলা ছুটোছুটি না করিয়া লেখাপড়া করা ভাল।

 আবার যেদিন দেবদাসের পত্র আইসে, সেদিনটি পার্ব্বতীর বড় সুখের দিন। সিঁড়ির দ্বারে চৌকাঠের উপর কাগজখানি হাতে লইয়া সারাদিন তাহাই পড়িতে থাকে। শেষে মাস-দুই অতিবাহিত হইয়া গেল। পত্র লেখা কিংবা পাওয়া আর তত ঘন ঘন হয় না; উৎসাহটা যেন কিছু কিছু কমিয়া আসিয়াছে।

 একদিন পার্ব্বতী সকালবেলায় জননীকে বলিল, মা, আমি আবার পাঠশালায় যাব।

 কেন রে? তিনি কিছু বিস্মিত হইয়াছিলেন।

 পার্ব্বতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আমি নিশ্চয় যাব।

 তা যাস্‌। পাঠশালা যেতে আমি আর কবে তোকে মানা করেচি মা?

 সেইদিন দ্বিপ্রহরে পার্ব্বতী দাসীর হাত ধরিয়া, বহুদিন-পরিত্যক্ত শ্লেট ও বইখানি খুঁজিয়া বাহির করিয়া, সেই পুরাতন স্থানে গিয়া শান্ত, ধীরভাবে উপবেশন করিল।

 দাসী কহিল, গুরুমশাই, পারুকে আর মারধর করো না; আপনার ইচ্ছায়