পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দেবদাস
২৭

জুতা পায়ে দিয়া ছড়ি হাতে ময়দানে বাহির হইত। যাইবার সময় চক্রবর্তীদের বাড়ির পাশ দিয়াই যাইত,—পার্বতী উপরে জানালা হইতে চক্ষু মুছিতে মুছিতে তাহা দেখিত। কত কথা মনে পড়িত। মনে পড়িত, দু’জনেই বড় হইয়াছে,—দীর্ঘ প্রবাসের পর পরের মতো এখন পরস্পরকে বড় লজ্জা করে। দেবদাস সেদিন অমনি চলিয়া গিয়াছিল; লজ্জা করিতেছিল, তাই ভাল করিয়া কথাই কহিতে পারে নাই। এটুকু পার্ব্বতীর বুঝিতে বাকী ছিল না।

 দেবদাসও প্রায় এমনি করিয়াই ভাবে। মাঝে মাঝে তাহার সহিত কথা কহিতে, তাহাকে ভাল করিয়া দেখিতে ইচ্ছা হয়; কিন্তু অমনি মনে হয়, ইহা কি ভাল দেখাইবে?

 এখানে কলিকাতার সেই কোলাহল নাই, আমোদ-আহ্লাদ, থিয়েটার, গান-বাজনা নাই—তাই কেবলই তাহার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, সেই পার্ব্বতী এই পার্ব্বতী হইয়াছে! পার্ব্বতী মনে করে, সেই দেবদাস—এখন এই দেবদাসবাবু হইয়াছে! দেবদাস এখন প্রায়ই চক্রবর্তীদের বাটীতে যায় না। কোনদিন যদি-বা সন্ধ্যার সময় উঠানে দাঁড়াইয়া ডাকে, খুড়ীমা, কি হচ্ছে?

 খুড়ীমা বলেন, এসো বাবা, বোস।

 দেবদাস অমনি কহে—না থাক খুড়ীমা, একটু ঘুরে আসি।

 তখন পার্ব্বতী কোনদিন বা উপরে থাকে, কোনদিন বা সামনে পড়িয়া যায়। দেবদাস খুড়ীমার সহিত কথা কহে, পার্ব্বতী ধীরে ধীরে সরিয়া যায়। রাত্রে দেবদাসের ঘরে আলো জ্বলে। গ্রীষ্মকালের খোলা জানালা দিয়া পার্ব্বতী সেদিকে বহুক্ষণ হয়ত চাহিয়া থাকে—আর কিছুই দেখা যায় না। পার্ব্বতী চিরদিন অভিমানিনী। সে যে ক্লেশ সহ্য করিতেছে, ঘূণাগ্রে এ কথা কেহ না বুঝিতে পারে, পার্ব্বতীর ইহা কায়মন চেষ্টা। আর জানাইয়াই বা লাভ কি?

সহানুভূতি সহ্য হইবে না, আর তিরস্কার-লাঞ্ছনা?—তা তার চেয়ে তো মরণ ভাল। মনোরমার গত বৎসর বিবাহ হইয়াছে। এখনও সে শ্বশুরবাড়ি যায় নাই, তাই মাঝে মাঝে বেড়াইতে আসে। পূর্বে দুই সখীতে মিলিয়া মাঝে মাঝে এইসব কথাবার্তা হইত, এখনও হয়; কিন্তু পার্ব্বতী আর যোগ দেয় না—হয় চুপ করিয়া থাকে, না হয় কথা উলটাইয়া দেয়।

পার্ব্বতী পিতা কাল রাত্রে বাটী ফিরিয়াছেন। এ কয়দিন তিনি পাত্র স্থির