পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪০
দেবদাস

 তবে এসব কি করচ?

 যাবার উদ্যোগ করচি।

 চুনিলাল ঈষৎ হাসিয়া ভাবিল, মন্দ উদ্যোগ নয়; কহিল, ঘর-বাড়ি কি সব সেখানে নিয়ে যাবে নাকি হে?

 তবে কার কাছে রেখে যাব?

 চুনিলাল বুঝিতে পারিল না। কহিল, জিনিসপত্র আমি কার কাছে রেখে যাই? সব তো বাসায় পড়ে থাকে।

 দেবদাস যেন হঠাৎ সচেতন হইয়া চোখ তুলিল। লজ্জিত হইয়া কহিল, চুনিবাবু আজ আমি বাড়ি যাচ্ছি।

 সে কি হে? কবে আসবে?

 দেবদাস মাথা নাড়িয়া বলিল, আমি আর আসব না।

 বিস্ময়ে চুনিলাল তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিল। দেবদাস কহিতে লাগিল,—এই টাকা নাও; আমার যা কিছু ধার আছে, এই থেকে শোধ করে দিয়ো। যদি কিছু বাঁচে, বাসার দাসী-চাকরকে বিলিয়ে দিয়ো। আমি আর কখনো কলকাতায় ফিরব না।

 মনে মনে বলিতে লাগিল, কলকাতায় এসে আমার অনেক গেছে, অনেক গেছে।

 আজ যৌবনের কুয়াশাচ্ছন্ন আঁধার ভেদ করিয়া তাহার চোখে পড়িতেছে—সেই দুর্দান্ত দুর্বিনীত কিশোর বয়সের সেই অযাচিত পদদলিত রত্ন আজ সমস্ত কলিকাতার তুলনাতেও যেন অনেক বড়, অনেক দামী। চুনিলালের মুখপানে চাহিয়া বলিল, চুনি, শিক্ষা বিদ্যা বুদ্ধি জ্ঞান উন্নতি—যা কিছু, সব সুখের জন্য। যেমন করেই দেখ না কেন, নিজের সুখ বাড়ানো ছাড়া এসকল আর কিছুই নয়—

 চুনিলাল বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, তবে তুমি কি আর লেখাপড়া করবে না নাকি?

 না। লেখাপড়ার জন্যে আমার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। আগে যদি জানতাম, এতখানির বদলে আমার এইটুকু লেখাপড়া হবে, তাহলে আমি জন্মে কখনো কলিকাতার মুখ দেখতাম না।

 তোমার হয়েছে কি?

 দেবদাস ভাবিতে বসিল; কিছুক্ষণ পরে কহিল, আবার যদি কখন দেখা হয়, সব কথা বলব।

 রাত্রি তখন প্রায় নয়টা বাজিয়াছে। বাসায় সকলে এবং চুনিলাল নিরতিশয়