পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দেবদাস

 ভুলো শান্ত-গম্ভীর মুখে কহিল, কি আঁক?

 মণকষা-

 শেলেটটা দেখি-

 ভাবটা এই যে তাহার নিকট এসব কাজে শ্লেটখানি হাতে পাওয়ার অপেক্ষা মাত্র! দেবদাস তাহার হাতে শ্লেট দিয়া নিকটে দাঁড়াইল। ভুলো ডাকিয়া লিখিতে লাগিল যে, এক মন তেলের দাম যদি চৌদ্দ টাকা ন আনা তিন গণ্ডা হয়, তাহা হইলে-

 এমনি সময়ে একটি ঘটনা ঘটিল।—হাত-পা-ভাঙ্গা বেঞ্চিখানার উপর সর্দার- পোড়ো তাহার পদমর্যাদার উপযুক্ত আসন নির্বাচন করিয়া যথানিয়মে আজ তিন বৎসর ধরিয়া প্রতিদিন বসিয়া আসিতেছে। তাহার পশ্চাতে একরাশ চুন গাদা করা ছিল। এটি পণ্ডিত মহাশয় কবে কোন যুগে নাকি সস্তা-দরে কিনিয়া রাখিয়া-ছিলেন; মানস ছিল, সময় ভাল হইলে ইহাতে কোঠা-দালান দিবেন। কবে যে সে শুভদিন আসিবে তাহা জানি না, কিন্তু এই শ্বেত-চূর্ণের প্রতি তাঁহার সতর্কতা এবং যত্নের অবধি ছিল না। সংসারানভিজ্ঞ অপরিণামদর্শী কোন অলক্ষ্মী-অশ্রিত বালক ইহার রেণুমাত্র নষ্ট না করিতে পারে, সেইজন্য প্রিয়পাত্র এবং অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ভোলানাথ এই সযত্নে-সঞ্চিত বস্তুটি সাবধানে রক্ষা করিবার ভার পাইয়াছিল এবং সে বেঞ্চের উপর বসিয়া ইহাকে আগুলিয়া থাকিত।

 ভোলনাথ লিখিতেছিল,—এক মণ তেলের দাম যদি চৌদ্দ টাকা নয় আনা তিন গণ্ডা হয়, তাহা হইলেও গো বাবা গো-তাহার পর খুব শব্দ-সাড়া হইল। পার্বতী ভয়ানক উচ্চকঠে চেঁচাইয়া হাততালি দিয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। সদ্যানিদ্রোদ্বিত গোবিন্দ পণ্ডিত রক্তনেত্রে একেবারে উঠিয়া দাড়াইলেন। দেখিলেন, গাছতলায় ছেলের দল একেবারে সার বঁধিয়া হৈ হৈ শব্দে ছুটিয়া চলিতেছে এবং তখনি চক্ষে পড়িল যে, ভগ্ন বেঞ্চের উপর একজোড়া পা নাচিয়া বেড়াইতেছে এবং চুনের মধ্যে আগ্নেয়গিরির অগ্নেউপাত হইতেছে। চীৎকার করিলেন, কি-কি–কি রে।

 বলিবার মধ্যে শুধু পার্বতী ছিল। কিন্তু সে ভূবন ভূমিতলে লুটাইতেছে এবং করতালি দিতেছে। পণ্ডিত মহাশয়ের বিফল প্রশ্ন ক্রুদ্ধভাবে ফিরিয়া গেল, কি, কি-কি রে।