পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দেবদাস
৭৯

যখন ভালবাসা জানাও, কত কথায়, কত ভাবে যখন প্রকাশ কর, আমরা চুপ করে থাকি। অনেক সময় তোমাদের মনে ক্লেশ দিতে লজ্জা করে, দুঃখ হয়, সঙ্কোচে বাধে। মুখ দেখতেও যখন ঘৃণা বোধ হয়, তখনও হয়ত লজ্জায় বলতে পারিনে—আমি তোমাকে ভালবাসতে পারব না।

তার পরে একটা বাহ্যিক প্রণয়ের অভিনয় চলে; একদিন, যখন তা শেষ হয়ে যায়, পুরুষমানুষ রেগে অস্থির হয়ে বলে, কি বিশ্বাসঘাতক! সবাই সেই কথা শোনে,সেই কথাই বোঝে। আমরা তখনও চুপ করে থাকি। মনে কত ক্লেশ হয়, কিন্তু কে তা দেখতে যায়?

 দেবদাস কোন কথা কহিল না। সেও কিছুক্ষণ নিঃশব্দে মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, হয়ত একটা মমতা জন্মায়; স্ত্রীলোক মনে করে এই বুঝি ভালবাসা! শান্ত ধীরভাবে সংসারের কাজকর্ম করে, দুঃখের সময় প্রাণপণে সাহায্য করে, তোমরা কত সুখ্যাতি কর,—মুখে মুখে তার কত ধন্য ধন্য! কিন্তু হয়ত তখনো তার ভালবাসার বর্ণপরিচয় হয় না। তার পরে যদি কোন অশুভ মুহূর্তে তাহার বুকের ভেতরটা অসহ্য বেদনায় ছটফট করে বেরিয়ে এসে দাঁড়ায়, তখন—বলিয়া সে দেবদাসের মুখের পানে তীব্র দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, তখন তোমরা চিৎকার করে বলে ওঠো—কলঙ্কিনী! ছিঃ ছিঃ!

 অকস্মাৎ দেবদাস চন্দ্রমুখীর মুখে হাত চাপা দিয়া বলিয়া উঠিল—চন্দ্রমুখী, ও কি!

 চন্দ্রমুখী ধীরে ধীরে হাত সরাইয়া দিয়া কহিল, ভয় নেই দেবদাস, আমি তোমার পার্ব্বতীর কথা বলচি নে। বলিয়া সে মৌন হইল!

 দেবদাসও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অন্যমনস্কের মতো কহিল, কিন্তু কর্তব্য আছে তো! ধর্মাধর্ম আছে তো!

 চন্দ্রমুখী বলিল, তা তো আছেই। আর আছে বলেই, দেবদাস, যে যথার্থ ভালবাসে, সে সহ্য করে থাকে। শুধু অন্তরে ভালবেসেও যে কত সুখ, কত তৃপ্তি—যে টের পায়, সে নিরর্থক সংসারের মাঝে দুঃখ-অশান্তি আনতে চায় না। কিন্তু কি বলছিলাম দেবদাস,—আমি নিশ্চয় জানি, পার্ব্বতী তোমাকে একবিন্দুও ঠকায়নি, তুমি আপনাকেই ঠকিয়েচ। আজ এ-কথা বোঝবার তোমার সাধ্য নেই আমি জানি; কিন্তু যদি কখনো সময় আসে, তখন হয়ত দেখতে পাবে, আমি সত্য কথাই বলেছিলাম।

 দেবদাসের দু’চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। আজ কেমন করিয়া তাহার যেন