পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দেবদাস
৮১

 দেবদাস আশ্চর্য্য হইয়া কহিল, হাসলে যে?

 ও কিছুই নয়, শুধু একটা পুরানো কথা মনে পড়ে গেল। সে আজ দশ বছরের কথা—যখন আমি ভালবেসে ঘর ছেড়ে চলে আসি। তখন মনে হতো, কত না ভালবাসি, বুঝি প্রাণটাও দিতে পারি। তার পর একদিন তুচ্ছ একটা গয়না নিয়ে দু'জনের এমনি ঝগড়া হয়ে গেল যে, আর কখনো কেউ কারো মুখ দেখলাম না। মনকে সান্ত্বনা দিলাম, সে আমাকে মোটেই ভালবাসত না,—না হলে একটা গয়না দেয় না!

 আর একবার চন্দ্রমুখী নিজের মনে হাসিয়া উঠিল। পরক্ষণেই শান্ত গম্ভীরমুখে মৃদু মৃদু কহিল—ছাই গয়না! তখন কি জানতাম, একটু সামান্য মাথাধরা সারাবার জন্যেও অকাতরে এই প্রাণটা পর্যন্ত দেওয়া যায়! তখন না বুঝতাম সীতা-দময়ন্তীর ব্যথা, না বিশ্বাস করতাম জগাই-মাধাইয়ের কথা। আচ্ছা দেবদাস, এ জগতে সকলই সম্ভব, না?

 দেবদাস কিছুই বলিতে পারিল না; হতবুদ্ধির মতো ফ্যালফ্যাল করিয়া কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আমি যাই—

 ভয় কি, আরো একটু বসো। আমি তোমাকে আর ভুলিয়ে রাখতে চাইনে—সেদিন আমার কেটে গেছে। এখন তুমিও আমাকে যতখানি ঘৃণা কর, আমিও আমাকে ততখানি ঘৃণা করি; কিন্তু দেবদাস, একটা বিয়ে কর না কেন?

 এতক্ষণে দেবদাসের যেন নিশ্বাস পড়িল; একটু হাসিয়া কহিল, উচিত বটে, কিন্তু প্রবৃত্তি হয় না।

 না হলেও কর। ছেলেমেয়ের মুখ দেখলেও অনেক শান্তি পাবে। তাছাড়া আমারও একটা উপায় হয়। তোমার সংসারে দাসীর মতো থেকেও স্বচ্ছন্দে দিন কাটাতে পারব।

 দেবদাস সহাস্যে কহিল, আচ্ছা তখন তোমাকে ডেকে আনব।

 চন্দ্রমুখী তাহার হাসি যেন দেখিতেই পাইল না; কহিল, দেবদাস, আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে।

 কি?

 তুমি এতক্ষণ আমার সঙ্গে কথা কইলে কেন?

 কোন দোষ হয়েচে কি?

দেবদাস-৬