পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৬
দেবদাস

কান পাতিয়া কথাবার্ত্তা শুনিতে চায়—নানা লোকে নানা কথা বলে, যাহা শুনিতে চায়, তাহা কিন্তু শোনা যায় না—কেহ বা মুখ ঢাকিয়া হঠাৎ মুখের কাছে আসিয়া উপস্থিত হয়—স্পর্শ করিবার জন্য হাত বাড়ায়—শশব্যস্তে চন্দ্রমুখী সরিয়া যায়। দুপুরবেলা পুরাতন পরিচিত সঙ্গিনীদের বাড়ি বেড়াইতে যায়। কথায় কথায় প্রশ্ন করে,—কেহ দেবদাসকে জান?

 তাহারা জিজ্ঞাসা করে, কে দেবদাস?

 চন্দ্রমুখী উৎসুক হইয়া পরিচয় দিতে থাকে—গৌরবর্ণ, মাথায় কোঁকড়া চুল, কপালের বাঁ দিকে একটা কাটা দাগ, বড়লোক—অজস্র টাকা খরচ করে, কেউ চেন কি?

 কেহই সন্ধান দিতে পারে না। হতাশ বিষণ্ণমুখে চন্দ্রমুখী বাড়ি ফিরিয়া যায়। গভীর রাত্রি পর্যন্ত জাগিয়া রাস্তার পানে চাহিয়া থাকে। ঘুম পাইলে বিরক্ত হয়; মনে মনে কহে, এ কি তোমার ঘুমাইবার সময়?

 ক্রমে একমাস অতীত হইল, কেবলরামও ব্যস্ত হইয়া উঠিল। চন্দ্রমুখীর নিজেরও সন্দেহ হইতে লাগিল, বুঝি সে এখানে নাই। তবুও আশায় ভর করিয়া দেবতার চরণে কায়মনে প্রার্থনা করিয়া দিনের পর দিন অতিবাহিত করিতে লাগিল।


 কলিকাতা আসিবার পর দেড়মাস গত হইয়াছে। আজ রাত্রে তাহার অদৃষ্ট প্রসন্ন হইল। রাত্রি তখন এগারোটা—হতাশমনে বাড়ি ফিরিতেছিল, দেখিতে পাইল, পথের ধারে একটা ঘরের সম্মুখে একজন আপনার মনে কি বলিতেছে। চন্দ্রমুখীর বুকের মধ্যে ধড়াস করিয়া উঠিল। এ কণ্ঠস্বর যে পরিচিত! কোটি-কোটি লোকের মধ্যেও চন্দ্রমুখী সে স্বর বুঝিতে পারিত। স্থানটা একটু অন্ধকার, তাহাতে আবার লোকটা অত্যন্ত মাতাল হইয়া উপুড় হইয়া পড়িয়া আছে। চন্দ্রমুখী নিকটে গিয়া গায়ে হাত দিল—তুমি কে গা, এমন করে পড়ে আছ?

 লোকটা সুর করিয়া বলিল,—শুন সই, মনের মানুষ কই; যদি পাই কানু হেন স্বামী—

 চন্দ্রমুখীর আর সন্দেহ নাই, ডাকিল...দেবদাস?

 দেবদাস সেইভাবে বলিল, উঁ।

 এখানে পড়ে কেন, ঘরে যাবে?

 না, বেশ আছি—

 একটু মদ খাবে?

 'খাব' বলিয়া সে একেবারে চন্দ্রমুখীর গলা জড়াইয়া ধরিল। কিছুক্ষণ মুখপানে চাহিয়া বলিল, বাঃ, এ যে খাসা জিনিষ দেবদাস!

 চন্দ্রমুখীর কান্নায় হাসি মিশিল; কহিল, হাঁ, বেশ জিনিস; এখন আপাততঃ আমার কাঁধে ভর দিয়ে একটু এগিয়ে চল, একটা গাড়ি চাই ত।