পাতা:দেবী চৌধুরাণী - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৯).pdf/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮২
দেবী চৌধুরাণী

 নিশি মসনদ দেখাইয়া দিল। ব্রজেশ্বর শুধু গালিচায় বসিয়াছিল। বলিল, “কেন, আমি বেস্ বসিয়া আছি।”

 তখন নিশি সাগরকে বলিল, “ভাই, তোমার সামগ্রী তুমি তুলিয়া বসাও। জান, আমরা পরের দ্রব্য ছুঁই না।” হাসিয়া বলিল, “সোণা রূপা ছাড়া।”

 ব্র। তবে আমি কি পিতল কাঁসার দলে পড়িলাম?

 নিশি। আমি ত তা মনে করি—পুরুষমানুষ স্ত্রীলোকের তৈজসের মধ্যে। না থাকিলে ঘর সংসার চলে না—তাই রাখিতে হয়। কথায় কথায় সক্‌ড়ি হয়—মাজিয়া ঘষিয়া ধুইয়া, ঘরে তুলিতে নিত্য প্রাণ বাহির হইয়া যায়। নে ভাই সাগর, তোর ঘটি বাটি তফাৎ কর—কি জানি, যদি সক্‌ড়ি হয়।

 ব্র। একে ত পিতল কাঁসা—তার মধ্যে আবার ঘটি বাটি! ঘড়াটা গাড়ুটার মধ্যে গণ্য হইবারও যোগ্য নই?

 নিশি। আমি ভাই বৈষ্ণবী, তৈজসের ধার ধারি না—আমাদের দৌড় মালসা পর্য্যন্ত। তৈজসের খবর সাগরকে জিজ্ঞাসা কর।

 সাগর। আমি ঠিক কথা জানি। পুরুষমানুষ তৈজসের মধ্যে কলসী। সদাই অন্তঃশূন্য—আমরা যাই গুণবতী, তাই জল পূরিয়া পূর্ণকুম্ভ করিয়া রাখি।

 নিশি বলিল, “ঠিক বলিয়াছিস্—তাই মেয়েমানুষে এ জিনিষ গলায় বাঁধিয়া সংসার সমুদ্রে ডুবিয়া মরে।—নে ভাই, তোর কলসী, কলসী-পীড়ির উপর তুলিয়া রাখ্।”

 ব্র। কলসী মানে মানে আপনি পীড়ির উপর উঠিতেছে।

 এই কথা বলিয়া ব্রজেশ্বর আপনি মসনদের উপর উঠিয়া বসিল। হঠাৎ দুই দিক্‌ হইতে দুই জন পরিচারিকা—সুন্দরী যুবতী, বহুমূল্য বসন-ভূষণ-ভূষিতা—দুইটা সোণাবাঁধা চামর হাতে করিয়া, ব্রজেশ্বরের দুই পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল। আজ্ঞা না পাইয়াও তাহারা ব্যজন করিতে লাগিল। নিশি তখন সাগরকে বলিল, “যা, এখন তোর স্বামীর জন্য আপন হাতে তামাকু সাজিয়া লইয়া আয়।”

 সাগর ক্ষিপ্রহস্তে সোণার আলবোলার উপর হইতে কলিকা লইয়া গিয়া, শীঘ্র মৃগনাভি-সুগন্ধি তামাকু সাজিয়া আনিল। আলবোলায় চড়াইয়া দিল। ব্রজেশ্বর বলিলেন, “আমাকে একটা হুঁকায় নল করিয়া তামাকু দাও।”

 নিশি বলিল, “কোন শঙ্কা নাই—ঐ আলবোলা উৎসৃষ্ট নয়। কেহ কখন উহাতে তামাকু খায় নাই। আমরা কেহ তামাকু খাই না।”