পাতা:দেবী চৌধুরাণী - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৯).pdf/১৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১২
দেবী চৌধুরাণী

 প্র। এখন আর উপায় নাই। তোমার পান্সী ডাক—নিশি ও দিবাকে লইয়া শীঘ্র যাও।

 ব্রজেশ্বর আপনার পান্সী ডাকিল। পান্সীওয়ালা নিকটে আসিলে, ব্রজেশ্বর বলিল, “তোরা শীঘ্র পলা, ঐ কোম্পানির সিপাহীর ছিপ আসিতেছে; তোদের দেখিলে উহারা বেগার ধরিবে। শীঘ্র পলা, আমি যাইব না, এইখানে থাকিব।”

 পান্সীর মাঝি মহাশয়, আর দ্বিরুক্তি না করিয়া, তৎক্ষণাৎ পান্সী খুলিয়া প্রস্থান করিলেন। ব্রজেশ্বর চেনা লোক, টাকার ভাবনা নাই।

 পান্সী চলিয়া গেল দেখিয়া, প্রফুল্ল বলিল, “তুমি গেলে না?”

 ব্র। কেন, তুমি মরিতে জান, আমি জানি না? তুমি আমার স্ত্রী—আমি তোমায় শত বার ত্যাগ করিতে পারি। কিন্তু আমি তোমার স্বামী—বিপদে আমিই ধর্ম্মতঃ তোমার রক্ষাকর্ত্তা। আমি রক্ষা করিতে পারিব না—তাই বলিয়া কি বিপদকালে তোমাকে ত্যাগ করিয়া যাইব?

 “তবে কাজেই আমি স্বীকার করিলাম, প্রাণ রক্ষার যদি কোন উপায় হয়, তা আমি করিব।” এই বলিতে বলিতে প্রফুল্ল আকাশপ্রান্তে দৃষ্টিপাত করিল। যাহা দেখিল, তাহাতে যেন কিছু ভরসা হইল। আবার তখনই নির্ভরসা হইয়া বলিল, “কিন্তু আমার প্রাণ-রক্ষায় আর এক অমঙ্গল আছে।”

 ব্র। কি?

 প্র। এ কথা তোমায় বলিব না মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু এখন আর না বলিলে নয়। এই সিপাহীদের সঙ্গে আমার শ্বশুর আছেন। আমি ধরা না পড়িলে তাঁর বিপদ্ ঘটিলেও ঘটিতে পারে।

 ব্রজেশ্বর শিহরিল—মাথায় করাঘাত করিল। বলিল, “তিনিই কি গোইন্দা?”

 প্রফুল্ল চুপ করিয়া রহিল। ব্রজেশ্বরের বুঝিতে কিছু বাকি রহিল না। এখানে আজিকার রাত্রে যে দেবী চৌধুরাণীর সাক্ষাৎ পাওয়া যাইবে, এ কথা হরবল্লভ ব্রজেশ্বরের কাছে শুনিয়াছিলেন। ব্রজেশ্বর আর কাহারও কাছে এ কথা বলেন নাই; দেবীরও যে গূঢ় মন্ত্রণা, আর কাহারও জানিবার সম্ভাবনা নাই। বিশেষ দেবী এ ঘাটে আসিবার আগেই কোম্পানির সিপাহী রঙ্গপুর হইতে যাত্রা করিয়াছিল, সন্দেহ নাই; নহিলে ইহারই মধ্যে পৌঁছিত না। আর, ইতিপূর্ব্বেই হরবল্লভ কোথায় যাইতেছেন, কাহারও কাছে প্রকাশ না করিয়া দূরযাত্রা করিয়াছেন, আজও ফেরেন নাই। কথাটা বুঝিতে দেরি হইল