তৃতীয় পরিচ্ছেদ
যখন গৃহিণী ঠাকুরাণী হেলিতে দুলিতে হাতের বাউটির খিল খুঁটিতে খুঁটিতে কর্ত্তা মহাশয়ের নিকেতনে সমুপস্থিতা, তখন কর্ত্তা মহাশয়ের ঘুম ভাঙ্গিয়াছে; হাতে মুখে জল দেওয়া হইয়াছে—হাত মুখ মোছা হইতেছে। দেখিয়া, কর্ত্তার মনটা কাদা করিয়া ছানিয়া লইবার জন্য গৃহিণী ঠাকুরাণী বলিলেন, “কে ঘুম ভাঙ্গাইল? আমি এত ক’রে বারণ করি, তবু কেউ শোনে না!”
কর্ত্তা মহাশয় মনে মনে বলিলেন, “ঘুম ভাঙ্গাইবার আঁধি তুমি নিজে—আজ বুঝি কি দরকার আছে?” প্রকাশ্যে বলিলেন, “কেউ ঘুম ভাঙ্গায় নাই। বেস্ ঘুমাইয়াছি—কথাটা কি?”
গিন্নী মুখখানা হাসি-ভরাভরা করিয়া বলিলেন, “আজ একটা কাণ্ড হয়েছে। তাই বলতে এসেছি।”
এইরূপ ভূমিকা করিয়া এবং একটু একটু নথ ও বাউটি নাড়া দিয়া—কেন না, বয়স এখনও পঁয়তাল্লিশ বৎসর মাত্র—গৃহিণী, প্রফুল্ল ও তার মাতার আগমন ও কথোপকথনবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বলিলেন। বধূর চাঁদপানা মুখ ও মিষ্ট কথাগুলি মনে করিয়া, প্রফুল্লের দিকে অনেক টানিয়া বলিলেন। কিন্তু মন্ত্র তন্ত্র কিছুই খাটিল না। কর্ত্তার মুখ বৈশাখের মেঘের মত অন্ধকার হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, “এত বড় স্পর্দ্ধা! সেই বাগ্দী বেটী আমার বাড়ীতে ঢোকে? এখনই ঝাঁটা মেরে বিদায় কর।”
গিন্নী বলিলেন, “ছি! ছি! অমন কথা কি বলতে আছে—হাজার হোক্, বেটার বউ—আর বাগ্দীর মেয়ে বা কিরূপে হলো? লোকে বল্লেই কি হয়?”
গিন্নী ঠাকুরুণ হার কাত নিয়ে খেলতে বসেছেন—কাজে কাজেই এই রকম বদ রঙ্গ চালাইতে লাগিলেন। কিছুতেই কিছু হইল না। “বাগ্দী বেটীকে ঝাঁটা মেরে বিদায় কর।” এই হুকুমই বাহাল রহিল।
গিন্নী শেষে রাগ করিয়া বলিলেন, “ঝাঁটা মারিতে হয়, তুমি মার; আমি আর তোমার ঘরকন্নার কথায় থাকিব না।” এই বলিয়া গিন্নী রাগে গর্ গর্ করিয়া বাহিরে আসিলেন। যেখানে প্রফুল্লকে রাখিয়া গিয়াছিলেন, সেইখানে আসিয়া দেখিলেন, প্রফুল্ল সেখানে নাই।