৶৹
তাঁহার পড়াশোনা ছিল, এবং গভীর চিন্তার সাহায্যে পঠিত জ্ঞানকে তিনি পরিপাক করিয়াছিলেন। মনে রাখিতে হইবে, যে ‘দেবী চৌধুরাণী’র জন্য কাল ও স্থান, সে দুইটিই বিদ্রোহের সম্পুর্ণ উপযোগী করিয়া বাছিয়া লওয়া হইয়াছে। কাল, তখন মুঘল সাম্রাজ্যের দেশব্যাপী শান্তি ও শৃঙ্খলিত শাসন-পদ্ধতি অস্ত গিয়াছে, অথচ নবীন ব্রিটিশ শাসন দেশে স্থাপিত হয় নাই—এই দুই মহাযুগের সন্ধিস্থল; রাজনৈতিক গোধূলি অরাজকতার বিশেষ সহায়ক। আর স্থান, সীমান্ত প্রদেশ; ‘আনন্দমঠে’ বন্য ঝাড়খণ্ডের প্রবেশদ্বার বীরভূম জেলা, ‘সীতারামে’ সমুদ্রের প্রায় ধারে কোণঠেষা ভূষণা পরগণা, আর ‘দেবী চৌধুরাণী’তে রঙ্গপুর জেলা। মুঘলযুগে মোঙ্গোল জাতীয় কোচ ও আহোম রাজ্য তখন বর্ত্তমান রঙ্গপুর জেলার উত্তরের ও পুবের অনেকাংশ পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল; কখন আগাইত, কখন পিছাইত, সুতরাং যুদ্ধ, অন্ততঃ লুঠতরাজ নিত্যনৈমিত্তিক ছিল। সুবা বাঙ্গলার কেন্দ্রস্থ জেলাগুলিতে যেমন নিয়মবদ্ধ শাসন ও “সম্রাটের শান্তি” সজোরে প্রতিষ্ঠিত ছিল, সীমান্ত পরগণাগুলিতে তাহা ছিল না। মহামতি বার্ক একটি সুন্দর উপমা দিয়া দেখাইয়াছেন যে, বিস্তৃত সাম্রাজ্যের হৃৎপিণ্ড হইতে প্রেরিত রক্তের বেগ অতি দূরবর্ত্তী আঙ্গুলের ডগায় পৌঁছিতে পৌঁছিতে অত্যন্ত ক্ষীণ হইয়া পড়ে। বীরভূম, ভূষণা, রঙ্গপুরেও তাহাই হইত। এই চিরসত্য বঙ্কিমের সৃষ্ট বিদ্রোহীদের পথ সুগম করিয়া দেয়, তাঁহাকে কষ্টকল্পনার আশ্রয় লইতে হয় নাই।
আর তখন বাঙ্গলা দেশের রাজস্ব-বন্দোবস্তেও অরাজকতা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। টোডরমলের জমি মাপিয়া প্রজার নিকট হইতে খাজনা-নির্দ্ধারণের ব্যবস্থা (জব্তী) বাঙ্গলার কোন অংশে প্রচলিত হইবার সময় পায় নাই; সর্ব্বত্রই এক এক জন জমিদারের নিকট থোকে টাকা লইয়া বাঙ্গলার সুবাদার, তথা দিল্লীর বাদশাহ সন্তুষ্ট থাকিতে বাধ্য হইতেন। তাহাও আবার সব জেলায় নহে। মানসিংহের বঙ্গবিজয়ের পর রাঢ় অঞ্চলে মাত্র নিয়মিতভাবে ও নির্দ্দিষ্ট পরিমাণে রাজস্ব আদায় হইত। রাজশাহী (অর্থাৎ সমস্ত রাজশাহী ও পাবনা এবং বগুড়ার দক্ষিণ অংশ লইয়া) ইসলাম খাঁর সময়ে সম্পুর্ণ বশীভূত হইল, এবং ঘোড়াঘাট (অর্থাৎ বর্ত্তমান বগুড়া, দিনাজপুর ও রঙ্গপুর, এই তিনটি জেলার সীমানার মিলন-স্থানকে কেন্দ্র করিয়া তাহার চারি দিকে একটা বৃত্ত টানিলে যতটা জমি তাহার মধ্যে পড়ে, তাহা,) আরও পরে রীতিমত সরকারী খাজনা দিতে আরম্ভ করিল। ময়মনসিংহ জেলাটা তাহারও এক শত বৎসর পরে মুর্শিদ কুলী খাঁর প্রবল শাসনে নিয়মিত-রাজস্ব-প্রদায়ী জেলা হইল, এবং সেটা তাঁহার প্রতিষ্ঠিত নূতন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের