পাতা:দেবী চৌধুরাণী - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৯).pdf/৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

৶৹

পরিশ্রমে। এইরূপে রাষ্ট্রীয় শান্তি ও সুশাসন বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে সুবা বাঙ্গলার মোট রাজস্ব বাড়িতে লাগিল; মুর্শিদ কুলী খাঁ প্রথমে আকবরী জমা ছাড়াইয়া উঠেন, আলীবর্দ্দী তাহার উপর রাজকর কয়েক লাখ বাড়াইয়া দেন, এবং সর্ব্বশেষে হতভাগ্য মির কাসিম ইংরেজদের শোষণের ফলে মোট খাজনার পরিমাণ অসম্ভব রকম বেশী করিয়া তোলেন।

 কিন্তু নবাবের শাসনশক্তি যেই পলাসী ও উদুয়ানালার যুদ্ধের ফলে ভাঙ্গিয়া পড়িল, অথচ যখন ইংরেজেরা বণিকত্ব ত্যাগ করিয়া দেশশাসনের দায়িত্ব লইতে ইতস্ততঃ করিতেছিলেন, কোন রকমে খাজনার টাকা আদায় হইলেই তাঁহারা সন্তুষ্ট, ঠিক সেই সময়, সর্ব্বপ্রথমে সীমান্ত জেলাগুলিতে শান্তি গেল, অরাজকতা তন্দ্রা হইতে জাগিল, প্রজা দরিদ্র হইল, খাজনা কোথা হইতে আসিবে? মির কাসিমের বর্দ্ধিত হারের জমা আদায় করা মনুষ্যের সাধ্যাতীত হইল। তখন সরকারী তহসিলদারগণ প্রজাদের মারপিট এবং নিজেদের উদর পূরণের জন্য লুঠ আরম্ভ করিয়া দিল। ঠিক যেমন অযোধ্যা রাজ্য যত দিন অকর্ম্মণ্য নবাবদের অধীন ছিল, তত দিন কোন জেলায় খাজনা আদায় করিতে হইলে সিপাহীর পল্টন পাঠান আবশ্যক হইত, কখন কখন দুই একটা তোপও—এখানেও সেইরূপ হইল।

 ‘দেবী চৌধুরাণী’তে বর্ণিত যুগে ইংরেজেরা জমির অস্থায়ী বন্দোবস্ত করিতেন, নিলামে সর্ব্বোচ্চ দরে এক এক বৎসরের জন্য (পরে একবার ৫ বৎসরের জন্য জমিদারী ইজারা দেওয়া হইত। ইতিহাস-পাঠক সর্ব্বদেশেই দেখিয়াছেন যে, এই কুপ্রথার ফল ভীষণ প্রজাপীড়ন, চাষের হ্রাস, জমিদারদের সর্ব্বনাশ এবং রাজারও নিয়মিত বার্ষিক আয়ে দ্রুত অবনতি। দেশের এই দুর্দ্দশার চিত্র বঙ্কিম ঠিক আঁকিয়াছেন, ইহার কোন অংশ কল্পিত বা অতিরঞ্জিত নহে। কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩) আর যাহাই করুক না কেন, অনেক বৎসর ধরিয়া মফঃস্বলে শান্তি, প্রজার সুখ, এবং রাজস্বের নির্দ্দিষ্টতা আনিয়া দেয়। কিন্তু তাহা যখন ঘটে, তখন “দেবী চৌধুরাণী মরিয়াছে” এবং প্রফুল্ল এক পাল “বড় ডব্‌ডবে চোখ, গালফোলা” জমিদার-শাবক পালন করিতে ব্যস্ত; ডাকাত-রাণীর বজরা ভাঙ্গিয়া ফেলা হইয়াছে—তখন আর তাহার আবশ্যকতা নাই।

 আর একটা কথা বলা আবশ্যক। ঐ নিরস্ত্র বজরাটা যেরূপে ইংরেজ সিপাইদের ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়া লেফ্‌টেনাণ্ট ব্রেনান্‌কে বন্দী করিল, তাহা অসম্ভব মনে হইবে কি? জলের মধ্যে লাঠির কাছে সঙ্গীনের পরাজয় কি “বঙ্কিমের বিকৃত মস্তিষ্কের” কল্পনা মাত্র, যেমন একজন অতি প্রসিদ্ধ লেখক ‘আনন্দমঠে’ শান্তির ঘোড়াচড়াকে বর্ণনা করিয়াছেন? সেই যুগে ভারতের সত্য ইতিহাসে ঠিক এইরূপ ঘটনা দুই জায়গায় দেখিতে পাই। ডাঙ্গা