দেবীর চক্ষের জল আর থাকিল না—বর্ষাকালের ফুটন্ত ফুলের ভিতর যেমন বৃষ্টির জল পোরা থাকে, ডাল নাড়া দিলেই জল ছড়্ ছড়্ করিয়া পড়িয়া যায়, দেবীর চোখে তেমনি জল পোরা ছিল, ডাল নাড়া দিতেই ঝর্ ঝর্ করিয়া পড়িয়া গেল। দেবী তখন ঐ স্ত্রীলোককে কাণে কাণে বলিল, “আমি আর এ রঙ্গ করিতে পারি না। তুই কথা ক’। সব জানিস্ ত?”
এই বলিয়া দেবী সে কামরা হইতে উঠিয়া অন্য কামরায় গেল। ঐ স্ত্রীলোকটি দেবীর আসন গ্রহণ করিয়া, ব্রজেশ্বরের সহিত কথা কহিতে লাগিল। এই স্ত্রীলোকের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় আছে—ইনি সেই বামনশূন্য বামনী—নিশি ঠাকুরাণী।
নিশি বলিল, “এইবার ঠিক্ বলেছ—তোমার নাম ব্রজেশ্বর রায়।”
ব্রজেশ্বরের একটু গোল বাঁধিল। পরদার আড়ালে কিছুই দেখিতে পাইতেছিলেন না—কিন্তু কথার আওয়াজে সন্দেহ হইল যে, যে কথা কহিতেছিল, এ সে বুঝি নয়। তার আওয়াজটা বড় মিঠে লাগিতেছিল—এ বুঝি তত মিঠে নয়। যাই হউক, কথার উত্তরে ব্রজেশ্বর বলিলেন, “যদি আমার পরিচয় জানেন, তবে এই বেলা দরটা ঢুকাইয়া লউন—আমি স্বস্থানে চলিয়া যাই। কি দরে আমাকে ছাড়িবেন?”
নিশি। এক কড়া কাণা কড়ি। সঙ্গে আছে কি? থাকে যদি, দিয়া চলিয়া যান।
ব্রজ। আপাততঃ সঙ্গে নাই।
নিশি। বজরা হইতে আনিয়া দিন।
ব্রজ। বজরাতে যাহা ছিল, তাহা আপনার অনুচরেরা লইয়া আসিয়াছে। আর এক কড়া কাণা কড়িও নাই।
নিশি। মাঝিদের কাছে ধার করিয়া আনুন।
ব্রজ। মাঝিরাও কাণা কড়ি রাখে না।
নিশি। তবে যত দিন না আপনার উপযুক্ত মূল্য আনাইয়া দিতে পারেন, তত দিন কয়েদ থাকুন।
ব্রজেশ্বর তার পর শুনিলেন, কামরার ভিতরে আর একজন কে—কণ্ঠে সেও বোধ হয় স্ত্রীলোক—দেবীকে বলিতেছে, “রাণীজি! যদি এক কড়া কাণা কড়িই এই মানুষটার দর হয়, তবে আমি এক কড়া কাণা কড়ি দিতেছি। আমার কাছে উহাকে বিক্রী করুন।”