পাতা:নরওয়ে ভ্রমণ.pdf/১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০
নরওয়ে ভ্রমণ

রাস্তায় অনায়াসেই চড়িতে লাগিল। তখন মনে হইতেছিল যে, এ মর্ত্ত্যধাম ছাড়িয়া বুঝি কোন দেবলোকে গমন করিতেছি। সেদিন আকাশ মেঘশূন্য। এই বাহিরের জ্যোতিঃ আজ যেন অন্তর মধ্যে প্রবেশ করিয়া সেখানকার সকল অন্ধকার দূর করিয়া দিয়া এক অপূর্ব্ব আনন্দে মাতাইয়া তুলিল। আজ আর ক্ষুদ্রতা সেখানে তিষ্ঠিতে পরিতেছে না, হিংসা দ্বেষের আর স্থান নাই। আজ এই ক্ষুদ্র মানবহৃদয়কে যেন এক মহান্ ভাবে মহীয়ান্ করিয়া তুলিয়াছে। আজ সে দিব্যচক্ষু লাভ করিয়া যেন সকল অদৃশ্য বস্তুর সন্ধান পাইয়াছে, সে আর সীমতে আবদ্ধ থাকিতে চাহিতেছে না। তাহার দিব্য কর্ণ আজ চরাচর সকলের আহ্বান জানিতে সমর্থ হইয়াছে। আজ অদ্রিরাজি হস্তপ্রসারণপূর্ব্বক আমাদিগকে আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করিতেছে। আর কলকলবাহিনী নির্ঝরিণী প্রগল্ভা রমণীর মত অমাদিগের কুশল জিজ্ঞাসা করিতেছে। আমরা প্রকৃতি-দেবীর ইঙ্গিত মত এক নিভৃত কক্ষে গিয়া তাঁহার আতিথ্য স্বীকার করিলাম। চারিদিকে হাসির লহরী কর্ণে প্রবেশ করিতেছে, আর ভাবিতেছি আমরা দীন ভারতবাসী, আমাদের এত আনন্দ করা অভ্যাস নাই। কোন্ তপস্যার ফলে এ রাজ্য দুঃখের বার্ত্তা জানে না? এদেশে মেঘ নাই, বৃষ্টি নাই, অন্ধকার নাই, অমাবস্যাও নাই। এত প্রাণভরা হাসি আর আকাশভরা আলো ত আর কখন দেখি নাই। এখানে প্রকৃতি-সুন্দরীর এই থর থর কম্পন কি শৈত্য নিবন্ধন, না সাত্ত্বিক ভাবের নিদর্শন, সহসা বুঝিতে পারিলাম না। আজ বুঝিলাম

বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহার,
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমার”।

 তাই এই দেশীয় ভাষার অজ্ঞতা হেতু এতদিন যে বড় বিব্রত ছিলাম, আচম্বিতে যেন সে বাঁধ খুলিয়া গেল। অজি ভাষার বিভিন্নতায়ও মনের ভাব ব্যক্ত করা কঠিন হইতেছে না। মানুষ যাহা বোঝে না, আজ উদ্ভিদ জঙ্গম তাহা বুঝিয়া আমাদিগকে কত আদর করিতেছে, কত আশীর্ব্বাদ করিতেছে, কত কথা জানাইতেছে! ভাষা যেখানে মূক, অন্তরের ভাব সেখানে মুখর, শরীর যেখানে নিশ্চল স্পন্দনহীন, আত্মার সেখানে গতি বড় দ্রুত। এ কাহার লীলা? এ কোন্ দিব্য শক্তির প্রভা?

 কিছুক্ষণ পরে আমরা সেই নিভৃত কক্ষের নিকট বিদায় লইয়া ক্রমে ঊর্দ্ধপথে যাত্রা করিলাম। দূর হইতে দেখি, এক সুবৃহৎ সৌধ-সম্মুখে আমাদিগের শকটগুলি দণ্ডায়মান রহিয়াছে। বুঝিলাম, এ স্থানে আমাদের luncheon, অর্থাৎ মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা