পাতা:নরওয়ে ভ্রমণ.pdf/৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৪
নরওয়ে ভ্রমণ

সলিল ছিল, অথবা ইহা নিরবচ্ছিন্ন নীহারে আবৃত থাকিত কি না— আজ দেখিয়া তাহা নিরাকরণ করা সুকঠিন। এককালে যে চতুস্পার্শ্বস্থ হিমাদ্রি-শ্রেণীর হিমানীনিচয় বিগলিতধারায় প্রবাহিত হইয়া ইহারই উদ্দেশে যাত্রা করিয়াছিল,—এই হ্রদ যে তাহারই পরিণতি ——আজও তাহার বহু নিদর্শন বর্ত্তমান। কিন্তু তাহারা এখানে আসিয়া ও শৈত্যের প্রতাপ হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিতে না পারিয়া, যেন যেখানে-সেখানে পড়িয়া আতঙ্কে নিস্পন্দ—হৃতচৈতন্য ইয়া পাষাণবৎ পড়িয়া আছে। আবার কোথাও, যেন আপনাদের অন্তর্জ্বালা নিরুদ্ধ রাখিতে না পারিয়া, এই পাষাণ ভেদ করিবার উপক্রম করিতেছে। কোথাও আবার কাটে-ফাটে-ফাটেনা গোছ হইয়া রহিয়াছে। তীক্ষ্ণরশ্মির করজালকে এরাজ্যে সততই সংযত রাখিতে হয় বলিয়া, তিনিও এতদঞ্চলে নিষ্ক্রিয়— স্তব্ধ! নচেৎ এমন স্নিগ্ধ কোমল তুষারকে চির-পাষাণে রূপান্তরিত করিয়া রাখিবার সাধ্য ছিল কার?

 এদিক্‌ ছাড়িয়া যখন সেই হ্রদের অপর দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম, দেখিলাম, নীলনিভ কি দেখা যাইতেছে। ঊর্দ্ধে— দিগ্বলয় পর্য্যন্ত-আকাশের নীলিমা ব্যতীত, এ বর্ণ ত এরাজ্যে অন্যত্র নয়নগোচর হইবার কথা নয়।— তুষারে আকাশ প্রতিবিম্বিত হইলে ত ওরূপ দৃষ্ট হইত না! ও যে স্বচ্ছসলিল-ক্ষেত্র। কোন্ উত্তাপ তবে এ পাষাণ বিগলিত করিয়া জীবনে পরিণত করিল! নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে ভূধরগর্ভস্থিত কোন গুপ্ত-রহস্য নিহিত আছে! এই আধ-ধবল, আধ-শ্যামল শোভা নিরীক্ষণ করিয়া ত আর আশ মিটে না।—এ কি মাধুর্য্য!— কাহার মধুরিমার এ প্রত্যক্ষ প্রকাশ—এ জাজ্বল্যমান বিকাশ! তখন মনে পড়িল, আজ যে আমরা এই অমরধামে এই মাধুষ্যামৃত পান করিয়া —কৃতার্থ হইবার আশয়েই নিমন্ত্রিত হইয়া আসিয়াছি। আহা! কতদিক্ হইতে, কত সৃষ্টপদার্থে, কত কৌশলে এই নিরবচ্ছিন্ন নিরবদ্য— মাধুরীধারা ঢালিয়া দিতেছে! আমি দুইটি মাত্র চক্ষু লইয়া কেমন করিয়া তাহা উপভোগ করিব? একেই পোড়া নয়নযুগলের শক্তি অতি ক্ষীণ, তাহাতে আবার অশ্রু আসিয়া সময়ে অসময়ে অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায়, সে যে যুক্তি মানে না, নিষেধ ও শোনে না। হায়! আজ চক্ষু থাকিতে অন্ধ হইলাম। সতৃষ্ণ হইয়া—পেয়সম্মুখীন, সন্নিহিত থাকিয়াও আঁখি নিজ আকুল পিপাসা মিটাইতে পারিল না। আজ বুঝিলাম, দিব্যধামে আসিয়া, দিব্যচক্ষু-সম্পন্ন না হইলে, সকল দিব্য-বস্তু-দর্শন সম্ভবপর নহে। অমৃতলাভ করিলাম—কিন্তু সেবনে পরিতৃপ্ত হইতে পারিলাম না—শুধু পাওয়ায় ত অমর হওয়া যায় না। আমরা