পাতা:নরওয়ে ভ্রমণ.pdf/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৬
নরওয়ে ভ্রমণ

পরিত্যক্ত চিহ্ন বলিয়া এত যত্নে রক্ষা করিতেছি, ইহা দেড়শত বৎসরের পুরাতন”। আমরাও তখন, সেই বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে সম্মান জানাইতে, উহা হাতে ছুঁইলাম এবং তারপর যথাস্থানে স্থাপন করিলাম। এতক্ষণ অবধি খুল্লতাত মহাশয় বড় একটা মুখ খোলেন নাই, সেটা তার ইংরাজী ভাষার অজ্ঞতা নিবন্ধন নিশ্চয়ই। আমরা ভদ্রতার খাতিরে দুই চার কথা তাঁকে বলিতেই তিনি মাথা নাড়িয়া, হাতের দিকে আকার ইঙ্গিতে একটা মস্ত “না”র সৃষ্টি করিয়া আমাদিগকে সে কথা বিনা কথায়ও বেশ স্পষ্টই বুঝাইয়া দিলেন। তারপর, যতটুকু সময় আমরা সেখানে ছিলাম, তিনি কখনও মৃদুমন্দ হাসিতে-কখনও একটু কৃত্রিম কাসিতে—আমাদিগের কথায় যোগ দিয়া আমাদিগকে যথেষ্ট আপ্যায়িত করিয়াছিলেন। বিদায়ের বেলা আমাদের নাম ধাম লিখিয়া আসিতে হইল; যদি কালে ভদ্রে আবার আসি, তবে খবর পাইলেই দেখা করিবেন বলিয়া। আর, ক্কচিৎ ভবিষ্যতে, যদি তাদেরই সুদূর ভারতবর্ষে যাইবার সুযোগ ঘটে, তবে আমাদিগকে স্মরণ করিবেন, নিশ্চয়;—এইরূপ প্রতিশ্রুত হইয়া, এবং আমাদের হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জানাইয়া—বাহিরে আসিলাম। তাঁরা দুই জনে সঙ্গে আসিয়া আমাদিগকে গাড়ীতে উঠাইয়া দিলেন।

 গাইড্ ভাবিল, যখন বিদেশীকে হাতে পাইয়াছি, তখন বক্‌সিস্‌টা একটু ভারি হাতে নেওয়াই যাক্‌ না কেন? মনে মনে এই ফন্দী আঁটিয়া, আমাদিগকে একটু এদেশটা ঘুরিয়া দেখিয়া যাইতে অনুরোধ করিল। আমরা মহা তুষ্ট হইয়াই তাহার এই আবেদন মঞ্জুর করিলাম। আর তাহাকে পায় কে? অনবরত, আশে পাশে ঘর বাড়ী, গাছ পালা, রাস্তা ঘাট সমুদায়েরই ইতিহাস—সেই ‘ডিকি বাক্সে’ বসিয়া, বলিয়া যাইতে লাগিল। মাঝে মাঝে আবার গাড়ী থামাইয়া স্থানবিশেষ বিশেষভাবে লক্ষ্য করাইতেছিল; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, সে সকল কথা সবই যে আমাদের কাণের ভিতর প্রবেশাধিকার লাভ করিয়াছিল, এমত বলা যায় না। কেন না বাহিরের এই স্নিগ্ধশ্যামল শোভা নানা কথা মনে জাগাইয়া তুলিতেছিল। ভাবিতেছিলাম—“তাইত। এ দেশের লোকেরাও কি সেই ‘শস্যশ্যামলাং মাতরম্’কে দেখিতে পায়? এদেয় মাও কি তেমনই সন্তানবৎসলা? এরা কি মায়ের সুসন্তান!—না কুসন্তান? মায়ের দেওয়া—খাবার, কাপড়েই এরা মানুষ?—না আমাদের মত পরমুখাপেক্ষী দীনদুঃখী নিতান্তই বেঁহুস। যাইতে যাইতে কত ভাবে কত লোককে চলাফিরা করিতে দেখিলাম, সকলেরই সমান প্রসন্নমূর্ত্তি। তাহাতেই মনে হইল যে, এরা আদৌ দুঃখের