পাতা:নরওয়ে ভ্রমণ.pdf/৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নরওয়ে ভ্রমণ
৩৯

বড় অনুতপ্ত ও লজ্জিত হইলেন। সকল দম্ভ দূরে গেল, মাটীর মত মাথা নীচু করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। কিন্তু প্রিয় বয়স্যের তবু মন উঠিল না। তিনি সেদিনকার মত বন্ধুর সহবাসে বীতস্পৃহা দেখাইয়া আনমনে আপনার কর্ত্তব্য কার্য্যে ফিরিয়া চলিলেন। আমরা তাঁকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিলাম না। ইঙ্গিতে আমাদের তরী ঘূরিয়া চলিল। তখন বিজ্ঞাপনের আশ্রয় লইলাম। তাতে জানিলাম যে, এই ফিয়ড্ আমাদিগকে “Gudvangen” নামক স্থানের প্রারম্ভ পর্য্যন্ত লইয়া যাইবে। তারপর সেখান হইতে অশ্বযানে অর্দ্ধ-পথ চলা। যে, ইচ্ছা করিবে, সেই অর্দ্ধ-পথ হইতে ফিরিয়া আসিয়া জাহাজে জলপথে সে স্থানের শেষ সীমায় পৌঁছিতে পারিবে। যার ইচ্ছা সেখান হইতে রেল গাড়ীতে গিয়া, তার পরদিন আসিয়া সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হইবে। এস্থলে যে অনেকেই রেলপথে যাওয়া স্থির করিলেন, সেটা দেশ দেখিবার উৎসাহে যত না হউক, জলনিধির গত রাত্রের গরম মেজাজের জন্যই বেশী।

 ফিয়ডের এলাকা শেষ হইতে না হইতেই, কুক্ কোম্পানীর ভেরীর ভাঙ্গা-গলার বিকট আওয়াজ কাণে গেল। আজ বহুদূরের পথ যাইতে হইবে বলিয়া ভাল ভাল ঘোড়ার গাড়ী হাজির রহিয়াছে দেখিলাম অশ্বগণ তেজ সংবরণ করিতে না পারিয়া ক্রমাগত নাচিতেছে, দাঁড়াইয়া থাকিতে চাহিতেছে না। জল ছাড়িয়া জমিতে পা দিতেই, বন্ধুভাবে কে আসিয়া কাছে দাঁড়াইল। তখন ভাবিলাম, কি কুক্ষণেই বিধি আমাদের গায়ে কাল রঙ্ মাখাইয়াছিলেন। তার আকর্ষণেই না এ সকল স্থানের পথ-প্রদর্শকগণ হাস্যবদনে আমাদের সন্নিধানেই আসিতে ব্যস্ত। তা, যারা স্থানের ইতিহাস বলিয়া দেয়, চিত্রপরিচয় করায়, তারা কিছু মন্দ লোক নয়। বরং সহযাত্রীদের অনেকেরই আমাদের প্রতি কুটিল-কটাক্ষ যে, আমরা গাইড্ ভায়াদের একচেটিয়া করিয়া লইয়াছি।

 আজ যে উপত্যকার মধ্য দিয়া যাইতেছি, তার দুই দিকেই দুইটি স্বচ্ছসলিলা স্রোতস্বতী প্রবাহিত। মনে হইল এই যে, চতুর্দ্দিকে ধ্যানপরায়ণ যোগিগণ, যুগ যুগান্তর হইতে সমাধিস্থ হইয়া আপনাদের পবিত্র দেহকে পাষাণবৎ করিয়া রাখিয়াছেন, বুঝিবা তাঁহাদেরই সুকৃতির ফলে এই স্থান দিয়া নিরন্তর এই পুণ্যপ্রবাহ বহিয়া থাকে। কাল অনন্ত, আর সৃষ্টিলীলাও অপরিমিত, তাই এই ক্ষুদ্র প্রাণ এই স্থানের কিছুরই সন্ধান পাইতেছে না, অভূতপূর্ব্ব রহস্যে পড়িয়া যেন বিমুগ্ধ হইয়া আছে।