পাতা:নরওয়ে ভ্রমণ.pdf/৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৪
নরওয়ে ভ্রমণ

হাসিমুখে তাকে বসিতে বলিতে হইল। জানি, যে আজ তার বক্ত্তৃতা বহুক্ষণ চলিবে। কেন না কত নদী, কত হ্রদ, কত পাহাড়, কত পর্ব্বত, কত পল্লী, কত জনপদ অতিক্রম করিয়া যাইতে হইবে, তাহা সে হোটেল রক্ষিত মানচিত্রে দেখিয়া আসিয়াছিলাম। সকলের নাম, ছাই মনেও থাকে না—উচ্চারণ ত ঠিক হয়ই না, শুধুই শোনা, তাও আবার সকল সময় হইয়া উঠে না—এই বড় আপসোস্। কথায় কথায় সে ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল “আমাদের দেশটা দেখিতে কেমন? এতই কি সুন্দর?” হা কপাল। দেশের কিই বা দেখিয়াছি যে, মুখ ভরিয়া তার বর্ণনা করিব। সেই আমাদের “সূর্য-করোজ্জ্বল ধরণী”ই না “ভুবন মনোমোহিনী”। তার তুঙ্গ গিরিশৃঙ্গের কাছে দাঁড়াইতে পারে, এমন কোন্ শিখর জগতে আছে? তার শুভ্র তুষার-কিরীটের তুলনায় আর সব লাগে কোথায়? শুধু শোভায় কেন? “প্রথম প্রচারিত যার বন-ভ_নে, জ্ঞান ধর্ম্ম কত পুণ্য কাহিনী” আজও তাকে দেখিতে দূর-দূর দেশান্তর হইতে দলে দলে কত কত লোক আসিতেছে! আর আমরা অমন আপনার দেশ অহেলা করিয়া পরের দেশে ছুটিয়া আসিয়াছি! ছি! লজ্জার কথা! তবে ঐ যা বলেছি, কষ্ট স্বীকার করিয়া নিজের দেশ দেখা, কলিকালের আমাদের সভ্য-সমাজের সুখী প্রাণে হয় না। তীর্থদর্শনের পুণ্যফলে তাদের তেমন আস্থা নাই বলিয়া, পথঘাটের সাবেকী ধরণের ব্যবস্থা তাদের মাপিকসই নয়। তাতে, দীনদুঃখীরও প্রাণের যে ভক্তিবল, পথের আসল সম্বল, তাও তাদের নাই। এমন অবস্থায় যদি P. & O. আর কুক্ কোম্পানীকে পয়সা দিলেই তারা সুখসুবিধায় এ সকল রাজ্য দেখায়, তবে পথকষ্ট-অসহিষ্ণু, সৌখীনপ্রাণ প্রলুব্ধ না হবে কেন? অতএব আপনা হইতেই যে নিজ দোষদুর্ব্বলতা মাথা পাতিয়া মানিয়া লয়, তাকে আর পরিহাস বাক্যে মর্ম্মাহত করা সজ্জনোচিত হয় কি? যাক্, নির্ব্বাক দেখিয়া সে বাক্যবাগীশ একটু ব্যঙ্গভরে প্রশ্ন করিল যে, “সে যে শুনিয়াছে, আমাদের দেশটা একটা বাঘভাল্লুকের মুল্লুক, তাই কি?” আর সহ্য হইল না— অমনই গ্রীবা উন্নত করিয়া বলিলাম—  “হাঁ, আমাদের দেশে বাঘ ভাল্লুক বাস করে বটে, কিন্তু তা বলিয়া তাদেরই মুল্লুক একথা মানিতে পারি না। কি জান! দেশটা বহু বিস্তৃত হইলেই, তার ঝোপ জঙ্গল থাকবেই; তাতে গ্রীষ্মপ্রধান দেশ! যদি জিজ্ঞাসা কর, ইণ্ডিয়াটা কত বড়? তবে এক কথায় এই বলিতে পারি যে, তোমাদের মত কত নরওয়ে, তার মধ্যে অনায়াসে পূরিয়া রাখিতে পার, কেহ টেরও পাবে না। এত যে তোমরা পাহাড়ের বড়াই কর?