পাতা:নরওয়ে ভ্রমণ.pdf/৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নরওয়ে ভ্রমণ
৪৭

আপন চিঠিপত্র চাহিয়া আনিবার জন্য কেবিনের গায়ে বিজ্ঞাপন রাখা হইয়াছে। তাহাতে চোখ পড়িবামাত্র ছুটিতে হইল! কতদিন পরে দেশের খবর পাইব। মঙ্গল সংবাদ কি না, সঙ্গে সঙ্গে সে আশঙ্কা থাকাতে, প্রাণটা ছুটিলেও পাটা পিছে পড়িয়া থাকিতে চাহিল।

 জাহাজের ‘মেইল ডে’ এক মস্ত মহোৎসবের ব্যাপার। মা আছেন —সন্তানের সংবাদের আশায় উৎগ্রীব হইয়া, স্ত্রী থাকেন—স্বামীর খবরের অপেক্ষায় মুখ বাড়াইয়া, তরুণ প্রেমাসক্ত পাগলেরা আসে একেবারে কাণ্ডাকাও শূন্যভাবে দৌড়িয়া;—দূরে দাঁড়াইয়া এসব ভাবভঙ্গী পর্য্যবেক্ষণ করিতে, কি যে আমোদ লাগে বলা যায় না। যার যার পদবীর প্রথম অক্ষরের পর্য্যায়ক্রমে চিঠি বাছিয়া রাখিবার নিয়ম। সভ্য দেশের সব বিষয়েই আবার পুরুষের আগে স্ত্রীলোকের পালা। সুতরাং পরবর্ত্তী জনদিগের এস্থলে উতলা হইয়া কোন লাভ নাই জানিয়া আশৈশব পুরুষজাতি এই সংযম শিক্ষা করে। আজও ইহারা, প্রাণের ভিতরে যাই করুক, মুখটী বুজিয়া, হাসিটী তাতে নিবেশ করিয়া নিজ নিজ অবসর অপেক্ষা করিতেছে। ইহা প্রশংসনীয় বলিতেই হইবে। সে কর্ম্মচারীর ঘরটী যে দূরে ছিল তা নয়, কিন্তু আজকার দিনে সেখানে পৌঁছান এক সমস্যা হইয়া দাঁড়াইল। একে লোকে লোকারণ্য, তাতে দাঁড়াইবার জায়গাটী অতি সঙ্কীর্ণ, বিধিকৃতে আমাদের গায়ের রঙ্‌টী আবার কৃষ্ণবর্ণ,—কি জানি আমাদের সংস্পর্শে পাছে শ্বেতাঙ্গ বিবর্ণ হইয়া যায়, সেই ভয়ে বলপূর্ব্বক অগ্রসর হওয়ার পক্ষে আমাদের মহা অন্তরায় ছিল। যদি বা দেহের দৈর্ঘ্য তেমন থাকিত, তবুও দূর হইতে, সে লিপিদানকর্ত্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া, কার্য্য সম্পন্ন করিবার চেষ্টা করা যাইত। কিন্তু বিধাতপুরুষ তাতেও যে চিরবঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছেন। এদেশের এত সব দীর্ঘাকার শ্বেতাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গিনীদের মধ্যে দাঁড়াইলে খর্ব্বকায় আমরা একেবারে অদৃশ্য হইয়া পড়ি যে! যাহা হউক, কোন প্রকারে পত্রাদি হস্তগত করিয়া প্রস্থান করিলাম এবং তাহা পাঠ করিয়া সকলের মঙ্গল সংবাদ নিয়া উৎকণ্ঠার উপশম করিলাম।

 হঠাৎ কেমন চটাচট্ কতকগুলা পায়ের শব্দ কাণে গেল। চাহিয়া দেখি, আমাদের খালাসী সব ছুটাছুটি করিতেছে, আর “আগুন” “আগুন” কি বলিতেছে। প্রথমে মনে আতঙ্ক হইল বুঝিবা জাহাজে অগ্নিকাণ্ড উপস্থিত। কিন্তু ডেকে আসিতেই দূরবীক্ষণের ধুম দেখিয়া সে ভয় দূর হইল, বুঝিলাম পারে কোথাও।