বিয়ের পর তিনি বেঁচে ছিলেন বছর দশেক, কিন্তু আমি তাঁকে কিছুতেই আমল দিতাম না। মাঝে মাঝে ভয় দেখাতেন, বলতেন—উইলে কিছু দিয়ে যাবেন না। আমি সে কথায় ভ্রূক্ষেপও কর্তাম না। লোকটার একটা বড় দুর্ব্বলতা ছিল, আমাকে বড় ভালবাস্তেন, তাই আমার এত দোষ সত্ত্বেও আমাকে সব দিয়ে গেলেন। আমি উইল পড়ে লজ্জা পেয়েছিলাম। আজ অবধি তার এক পয়সাও নিজে ছুঁই নাই; আর আমাদের দেশের হিসাবে কোন ভাল কাজেও তা দিই নাই। তোমার হয় ত জানতে কৌতুহল হচ্ছে, যে সে টাকাগুলি কি করলাম? তোমাকে ডেকে যে আজ এসব কথা কেন বল্ছি, তা নিজেই জানি না। বোধ হয় এত দূরদেশের লোকের সঙ্গে এর আগে কখনও আমার দেখা হয় নাই, তাই তোমার সঙ্গে পরিচয় করবার জন্যে আমার মনে একটা অসম্ভব আগ্রহ হয়েছিল; কিন্তু সাহস পাই নাই। আর একথাও মনে হয়েছিল যে, যদি তুমি আমার ভাষা না জান।” এই বলেই “আজ এ পর্য্যন্তই” বলে তিনি আপনার আরাম-কেদারায় মুখখানা রুমাল দিয়া ঢাকিয়া বসিয়া রহিলেন। এমন কোন খাপছাড়া কথা পাইলাম না যে, তাঁহাকে খেপা ভাবিব। ও রকম খামখেয়ালী বলেই বোধ হয়, ওঁর সঙ্গে আরও কথাবার্তা কহিবার জন্য প্রাণটা ব্যাকুল হইল। সুযোগ পাইলেই আবার তাঁহার তল্লাসে আসিব, এরূপ সংকল্প করিয়া স্থানান্তরে চলিয়া গেলাম। এখন আর আমাদের বন্ধুবান্ধবের অভাব নাই। সেদিন চলিয়া গিয়াছে।
জাহাজে আমরা তিন শত আশী জন আরোহীর মধ্যে কত দেশী লোকই যে ছিলাম তার ঠিকানা নাই। প্রথম দুই চারি দিন কেহ বড় আমাদের কাছে ঘেঁসিত না। কিন্তু তারপর হইতেই এই প্রাতঃসন্ধ্যার শুভকামনাসূচক সম্ভাষণ প্রতি গ্রহণ করিতে করিতে আমাদের একেবারে প্রাণান্ত। ইহার একটি গুপ্ত কারণ ছিল। প্রথমে যখন আমরা কৃষ্ণকায় কজন এই জলযানে অধিরোহণ করি, তখন দূর হইতে কুটিল ভ্রুকুটি ভিন্ন আমাদের ভাগ্যে আর বেশী কিছু জোটে নাই। ইহা লক্ষ্য করিয়া, দূরদর্শী দাদা আমার একটু বড়াই করিয়াই বলিয়াছিলেন, “সবুর কর না, যখন যাত্রীদিগের পদবীর সহিত নামের তালিকা প্রকাশিত হবে, তখন এরাই কেমন উল্টা সুর ধরবে।” এই পদোপাসক জাতটা আগন্তুক হইতে, পরম আত্মীয় পর্য্যন্ত কেবল লোকের খেতাব-মাফিক খাতির করে। বস্তুতঃ কার্য্যেও তাহা দেখিয়া ভাবিলাম—ভাগ্যে ভগবান্, সম্প্রতি তাঁর কালো ছেলের “কৃষ্ণ” নামের