পাতা:নারীর মূল্য-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৫
নারির মূল্য

মূল নিহত আছে, ইহা যদি সে তলাইয়া দেখিতে চাহে সেখানে অখণ্ড স্বার্থপরতা ভিন্ন আর কিছুই সে দেখিতে পাইবে না। কিন্তু এ দেখা কটিন—পিতার পক্ষেও কঠিন, তাহার কন্যার পক্ষেও কঠিন। প্রতিষ্ঠিত নিয়ম পালনের মধ্যে মানুষ যখন একান্ত মগ্ন হইয়া থাকে, চোখের দৃষ্টিও তখন তাহার রুদ্ধ হইয়া যায়। সে কোনমতেই দেখিতে পায় না, কোন্‌টা ধর্ম কোন্‌টা অধর্ম। বৈদিক যজ্ঞের অগণিত পশু-হত্যার মধ্যে কোথায় অন্যায় ছিল, মানুষ তখনই শুধু দেখিতে পাইয়াছে বুদ্ধদেব যখন তাহাকে পৃথক্ করিয়া লইয়া গিয়াছেন। সহমরণ আজ রহিত হইয়া গিয়াছে, তাই আজ সে-কথা মনে করিয়া শিহরিয়া উঠি। গঙ্গাসাগরে সন্তান নিক্ষেপ করার মধ্যে কত পাপ গোপন ছিল, আজ তাহা দেখিতে পাইয়া ইংরাজের আইনকে সর্বান্তঃকরণে আশীর্বাদ করি। অথচ সে-সময় কত না লড়াই করিয়াছি। গাঁটের পয়সা অপব্যয় করিয়া বিলাত পর্যন্ত আপীল করিয়াছি। যাহারা প্রধান উদ্যোগী হইয়াছিল, আপীল করিতে বাধা দিতে সাহায্য করিয়াছিল, তাহাদিগকে পরম মিত্র বলিয়া আহ্বান করিয়াছি, স্বর্গীয় রামমোহনকে ধর্মদ্বেষী রাক্ষস বলিয়া গালি-গালাজ দিয়াছি। আজ সে ভ্রম বোধ করি ধরা পড়িয়াছে— তথাপি চৈতন্য হয় নাই। আজও সামাজিক প্রশ্নের মীমাংসা খুঁজিতে টোলের ভট্‌চায্যির নিকট ছুটিয়া যাই। কোন্‌টা ভাল, কোন্‌টা মন্দ, তাহাদিগকে গিয়া প্রশ্ন করি; কারণ তাহারা শাস্ত্রবিৎ। কিন্তু এ-কথাটা একবারো ভাবি না, তাহারা শাস্ত্রের শ্লোকই জানে—আর কিছু জানে না। বিদ্যার চরম উদ্দেশ্য যদি হৃদয় প্রশস্ত করা হয়, তাহাদের অধিকাংশেরই পড়া-শুনা যে ব্যর্থ হইয়াছে, তাহা একবারও চিন্তা করি না। মেয়ের কত বয়সে বিবাহ দেওয়া উচিত, জিজ্ঞাসা করিলে তাহারা শাস্ত্র আওড়ায়, বিধবা-বিবাহ উচিত কি না, জানিতে চাহিলে পুঁথি খুলিয়া বসে—মিলাইয়া দেখিতে চায় শ্লোকে কি বলে; শাস্ত্র তাহাদের দৃষ্টি ক্ষীণ করিয়া রাখিয়াছে। শাস্ত্রের বাহিরে তাহারা দেখিতে পায় না, শাস্ত্রের বাহিরে তাহারা পা বাড়াইতেও