পাতা:নারীর মূল্য-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৫
নারীর মূল্য

খুশী হইয়া সাহস দিয়া বলিতে থাকে, “তার আর কি! ও অমন হইয়া থাকে,—পুরুষের দোষ নেই। এসো বাহিরে এসো।” সেও তখন হাসি-মুখে বাহির হয়, এবং গলা বড় করিয়া প্রচার করিতে থাকে, নারীর পদস্খলন কিছুতেই মার্জনা করা যাইতে পারে না।

 ঠিক ত! যে কারণেই হৌক, যে নারী একটিবার মাত্রও ভুল করিয়াছে, হিন্দু তাহার সহিত কোন সংশ্রব রাখে না। ক্রমশঃ ভুল যখন তাহার জীবনে পাপে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, দিন দিন করিয়া যখন তাহার সমস্ত নারীত্ব নিঙড়াইয়া বাহির হইয়া যায়—যখন সে বেশ্যা, তখন আবার তাহার অভাবে হিন্দুর স্বর্গও সর্বাঙ্গসুন্দর হয় না। এতই তাহার প্রয়োজন। দেশের লোক আদর করিয়া যেমন শ্রীকৃষ্ণের ‘কালো সোনা’, ‘কালো মাণিক’ প্রভৃতি অষ্টোত্তর-শতনাম দিয়াছিল, সংস্কৃত সাহিত্যেও বোধ করি বেশ্যার আদরের নাম তার চেয়ে কম নয়। এই সকল হইতেই বুঝিতে পারা যায়, স্বার্থপরতা ও চরিত্রগত পাপ-বুদ্ধি নর-নারী কাহার অধিক, এবং সমাজ হইতে এই পাপ বহিষ্কৃত করিতে হইলে শাস্ত্রের কড়া আইন-কানুন কাহার সম্বন্ধে অধিক থাকা উচিত, এবং সামাজিক জীবন বিশুদ্ধ রাখা উদ্দেশ্য হইলে নর-নারী কাহাকে অধিক চোখে চোখে রাখা কর্তব্য, এবং শাস্তি কাহাকে অধিক দেওয়া আবশ্যক! অথচ, সমাজ নারীর ভুল-ভ্রান্তি এক-পাইও ক্ষমা করিবে না, পুরুষের ষোল-আনাই ক্ষমা করিবে। হেতু? হেতু শুধু গায়ের জোর; হেতু শুধু সমাজ অর্থে ‘পুরুষ’—‘নারী’ নয় বলিয়া। কাজটা ঘৃণার কাজ, তাই পুরুষ নারীকে ঘৃণা করে। তাহাকে ঘৃণা করিবার অধিকার দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু নারীকে সে অধিকার দেওয়া হয় নাই। পুরুষ যতই ঘৃণ্য হউক, সে স্বামী। স্বামীকে ঘৃণা করিবে স্ত্রী কি করিয়া? শাস্ত্র যে বলিতেছেন, তিনি যেমনই হউন না, সতী স্ত্রীর তিনি দেবতা, এবং এই দেবতাটির মৃত্যু ঘটিলে তাঁহার পদপঙ্কজ ক্রোড়ে করিয়া অনুগমন করা আবশ্যক। অন্ততঃ এ-যুগে তাঁহারই পদপঙ্কজ স্মরণ করিয়া জীবন্মৃত হইয়া থাকাতেই যথার্থ নারীত্ব।