মনোরম হইয়া গেল। পৃথিবীতে এ-পর্যন্ত যত মানুষ যত ভালোবাসিয়াছে সমস্ত যেন দুটিমাত্র হৃদয়ে বিভক্ত হইয়া অনির্বচনীয় সুখে-দুঃখে আকাঙ্ক্ষায়-আকুলতায় কম্পিত হইতে লাগিল।
সে দিন মেঘের মধ্যে যেমন ফাঁক ছিল না গানের মধ্যেও তেমনি হইয়া উঠিল। হেমনলিনী কেবল অনুনয় করিয়া বলিতে লাগিল, “অক্ষয়বাবু, থামিবেন না, আর-একটা গান, আর-একটা গান।”
উৎসাহে এবং আবেগে অক্ষয়ের গান অবাধে উৎসারিত হইতে লাগিল। গানের সুর স্তরে স্তরে পুঞ্জীভূত হইল, যেন তাহা সূচিভেদ্য হইয়া উঠিল, যেন তাহার মধ্যে রহিয়া রহিয়া বিদ্যুৎ খেলিতে লাগিল— বেদনাতুর হৃদয় তাহার মধ্যে আচ্ছন্ন-আবৃত হইয়া রহিল।
সে দিন অনেক রাত্রে অক্ষয় চলিয়া গেল। রমেশ বিদায় লইবার সময় যেন গানের সুরের ভিতর দিয়া নীরবে হেমনলিনীর মুখের দিকে একবার চাহিল। হেমনলিনীও চকিতের মতো একবার চাহিল, যাহার দৃষ্টির উপরেও গানের ছায়া।
রমেশ বাড়ি গেল। বৃষ্টি ক্ষণকালমাত্র থামিয়াছিল, আবার ঝুপঝুপ শব্দে বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। রমেশ সে রাত্রে ঘুমাইতে পারিল না। হেমনলিনীও অনেক ক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া গভীর অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টি পতনের অবিরাম শব্দ শুনিতেছিল। তাহার কানে বাজিতেছিল—
বায়ু বহীঁ পুরবৈঞা, নীদ নহীঁ বিন সৈঞা।
পরদিন প্রাতে রমেশ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ভাবিল, ‘আমি যদি কেবল গান গাহিতে পারিতাম তবে তাহার বদলে আমার অন্য অনেক শিক্ষা দান করিতে কুণ্ঠিত হইতাম না।’
কিন্তু কোনো উপায়ে এবং কোনো কালেই সে যে গান গাহিতে পারিবে এ ভরসা রমেশের ছিল না। সে স্থির করিল, ‘আমি বাজাইতে