পাতা:নৌকাডুবি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আসন্ন বিচ্ছেদের সম্ভাবনায় রমেশ আজকাল খুব বেশি করিয়া হার্মোনিয়ম শিখিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। একদিন কথায় কথায় হেমনলিনী কহিল, “রমেশবাবু, আমার বোধ হয়, আপনার মত কিছু দিন বায়ু-পরিবর্তন দরকার। না বাবা?”

 অন্নদাবাবু ভাবিলেন, কথাটা সংগত বটে, কারণ ইতিমধ্যে রমেশের উপর দিয়া শোকদুঃখের দুর্যোগ গিয়াছে। কহিলেন, “অন্তত কিছু দিনের জন্য কোথাও বেড়াইয়া আসা ভালো। বুঝিয়াছ রমেশ, পশ্চিমই বলো আর যে দেশই বলো, আমি দেখিয়াছি, কেবল কিছু দিনের জন্য একটু ফল পাওয়া যায়। প্রথন দিনকতক বেশ ক্ষুধা বাড়ে, বেশ পাওয়া যায়, তাহার পরে যে কে সেই। সেই পেটভার হইয়া আসে, বুকজ্বালা করিতে থাকে, যা খাওয়া যায় তা-ই—”

 হেমনলিনী। রমেশবাবু, আপনি নর্মদা-ঝর্না দেখিয়াছেন?

 রমেশ। না, দেখি নাই।

 হেমনলিনী। এ আপনার দেখা উচিত, না বাবা?

 অন্নদা। তা বেশ তো, রমেশ আমাদের সঙ্গেই আসুন কেন। হাওয়া-বদলও হইবে, মার্বল-পাহাড়ও দেখিবে।

 হাওয়া-বদল করা এবং মার্বল-পাহাড় দেখা, এই দুইটি যেন রমেশের পক্ষে সম্প্রতি সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়, সুতরাং রমেশকেও রাজি হইতে হইল।

 সেদিন রমেশের শরীর মন যেন হাওয়ার উপরে ভাসিতে লাগিল। অশান্ত হৃদয়ের আবেগকে কোনো একটা রাস্তায় ছাড়া দিবার জন্য সে আপনার বাসার ঘরের মধ্যে দ্বার রুদ্ধ করিয়া হার্মোনিয়মটা লইয়া পড়িল। আজ আর তাহার ষত্ব-ণত্ব-জ্ঞান রহিল না— যন্ত্রটার উপরে তাহার উন্মত্ত আঙুলগুলা তাল-বেতালের নৃত্য বাধাইয়া দিল।

৪১