পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

প্রাঞ্জলতা

 ক্ষিতি এবং সমীর ইহার পরে আর কোনো কথা বলিতে ইচ্ছা করিল না। কিন্তু ব্যোম অম্লান মুখে বলিতে লাগিল, ‘যাহা সরল তাহাই যে সহজ এমন কোনো কথা নাই। অনেক সময় তাহাই অত্যন্ত কঠি; কারণ, সে নিজেকে বুঝাইবার জন্য কোনো প্রকার বাজে উপায় অবলম্বন করে না, সে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকে, তাহাকে না বুঝিয়া চলিয়া গেলে সে কোনোরূপ কৌশল করিয়া ফিরিয়া ডাকে না। প্রাঞ্জলতার প্রধান গুণ এই যে, সে একেবারে অব্যবহিত ভাবে মনের সহিত সম্বন্ধ স্থাপন করে, তাহার কোনো মধ্যস্থ নাই। কিন্তু যে সকল মন মধ্যস্থের সাহায্য ব্যতীত কিছু গ্রহণ করিতে পারে না, যাহাদিগকে ভুলাইয়া আকর্ষণ করিতে হয়, প্রাঞ্জলতা তাহাদের নিকট বড়োই দুর্বোধ। কৃষ্ণনগরের কারিগরের রচিত ভিস্তি তাহার সমস্ত রঙচঙ মশক এবং অঙ্গভঙ্গি দ্বারা আমাদের ইন্দ্রিয় এবং অভ্যাসের সাহায্যে চট করিয়া আমাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করিতে পারে; কিন্তু গ্রীক প্রস্তরমূর্তিতে রঙচঙ রকম-সকম নাই— তাহা প্রাঞ্চল এবং সর্বপ্রকার প্রয়াস-বিহীন। কিন্তু তাই বলিয়া সহজ নহে। সে কোনোপ্রকার তুচ্ছ বাহ্য কৌশল অবলম্বন করে না বলিয়াই, ভাবসম্পদ তাহার অধিক থাকা চাই।’

 দীপ্তি বিশেষ একটু বিরক্ত হইয়া কহিল, ‘তোমার গ্রীক প্রস্তরমূর্তির কথা ছাড়িয়া দাও। ও সম্বন্ধে অনেক কথা শুনিয়াছি এবং বাঁচিয়া থাকিলে আরো অনেক কথা শুনিতে হইবে। ভালো জিনিসের দোষ এই যে, তাহাকে সর্বদাই পৃথিবীর চোখের সামনে থাকিতে হয়, সকলেই তাহার সম্বন্ধে কথা কহে, তাহার আর পর্দা নাই, আব্রু নাই; তাহাকে আর কাহারও আবিষ্কার করিতে হয় না, বুঝিতে হয় না, ভালো করিয়া চোখ মেলিয়া তাহার প্রতি তাকাইতেও হয় না, কেবল তাহার সম্বন্ধে বাঁধি গৎ শুনিতে এবং বলিতে হয়। সূর্যের যেমন মাঝে মাঝে মেঘগ্রস্ত

১০৭