পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভদ্রতার আদর্শ

কি ভালো দেখাইত। হাতির যদি ঠিক ময়ুরের মতো পেখম হয় তাহা হইলে কি তাহার সৌন্দর্যবৃদ্ধি হয়। আবার ময়ুরের পক্ষেও হাতির লেজ শোভা পায় না। তেমনি আমাদের ব্যোমকে সমীরের পোশাকে মানায় না, আবার সমীর যদি ব্যোমের পোশাক পরিয়া আসে উহাকে ঘরে ঢুকিতে দেওয়া যায় না।’

 সমীর কহিল, ‘আসল কথা, বেশভূষা আচারব্যবহারের স্খলন যেখানে শৈথিল্য অজ্ঞতা ও জড়ত্ব সুচনা করে সেইখানেই তাহা কদর্ষ দেখিতে হয়। সেই জন্য আমাদের বাঙালিসমাজ এমন শ্রীবিহীন। লক্ষ্মীছাড়া যেমন সমাজছাড়া, তেমনি বাঙালিসমাজ যেন পৃথ্বীসমাজের বাহিরে। হিন্দুস্থানির সেলামের মতো বাঙালির কোনো সাধারণ অভিবাদন নাই। তাহার কারণ, বাঙালি কেবল ঘরের ছেলে, কেবল গ্রামের লোক। সে কেবল আপনার গৃহসম্পর্ক এবং গ্রামসম্পর্ক জানে, সাধারণ পৃথিবীর সহিত তাহার কোনো সম্পর্ক নাই— এ জন্য অপরিচিত সমাজে সে কোনো শিষ্টাচারের নিয়ম খুঁজিয়া পায় না। এক জন হিন্দুস্থানি, ইংরাজকেই হউক আর চীনেম্যানকেই হউক, ভদ্রতাস্থলে সকলকেই সেলাম করিতে পারে; আমরা সে স্থলে নমস্কার করিতেও পারি না, সেলাম করিতেও পারি না, আমরা সেখানে বর্বর। বাঙালি স্ত্রীলোক যথেষ্ট আবৃত নহে এবং সর্বদাই অসম্‌বৃত— তাহার কারণ, সে ঘরেই আছে; এই জন্য ভাশুর-শ্বশুর-সম্পর্কীয় গৃহপ্রচলিত যে সকল কৃত্রিম লজ্জা তাহা তাহার প্রচুর পরিমাণেই আছে, কিন্তু সাধারণ ভদ্রসমাজসংগত লজ্জা সম্বন্ধে তাহার সম্পূর্ণ শৈথিল্য দেখা যায়। গায়ে কাপড় রাখা বা না রাখার বিষয়ে বাঙালি পুরুষদেরও অপর্যাপ্ত ঔদাসীন্য; চিরকাল অধিকাংশ সময় আত্মীয়সমাজে বিচরণ করিয়া এ সম্বন্ধে একটা অবহেলা তাহার মনে দৃঢ় বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে। অতএব বাঙালির বেশভূষা চালচলনের অভাবে একটা

১৩৬