পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৬

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

অখণ্ডতা

 সমীর কহিল, ‘আমি যে কথাটা বলিয়াছি তাহা রীতিমতো তর্কের যোগ্য নহে। প্রথম বর্ষায় পদ্মা যে চরটা গড়িয়া দিয়া গেল তাহা বালি, তাহার উপরে লাঙল লইয়া পড়িয়া তাহাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিলে কোনো ফল পাওয়া যায় না। ক্রমে ক্রমে দুই-তিন বর্ষায় স্তরে স্তরে যখন তাহার উপর মাটি পড়িবে তখন সে কর্ষণ সহিবে। আমিও তেমনি চলিতে চলিতে স্রোতোবেগে একটা কথাকে কেবল প্রথম দাঁড় করাইলাম মাত্র। হয়তো দ্বিতীয় স্রোতে একেবারে ভাঙিতেও পারে, অথবা পলি পড়িয়া উর্বরা হইতেও আটক নাই। যাহা হউক, আসামির সমস্ত কথাটা শুনিয়া তার পর বিচার করা হউক।—

 ‘মানুষের অন্তঃকরণের দুই অংশ আছে। একটা অচেতন বৃহৎ গুপ্ত এবং নিশ্চেষ্ট, আর একটা সচেতন সক্রিয় চঞ্চল পরিবর্তনশীল। যেমন মহাদেশ এবং সমুদ্র। সমুদ্র চঞ্চল ভাবে যাহা কিছু সঞ্চয় করিতেছে, ত্যাগ করিতেছে, গোপন তলদেশে তাহাই দৃঢ় নিশ্চল আকারে উত্তরোত্তর রাশীকৃত হইয়া উঠিতেছে। সেইরূপ আমাদের চেতনা প্রতিদিন যাহা কিছু আনিতেছে ফেলিতেছে, সেই সমস্ত ক্রমে সংস্কার স্মৃতি অভ্যাস -আকারে একটি বৃহৎ গোপন আধারে অচেতন ভাবে সঞ্চিত হইয়া উঠিতেছে। তাহাই আমাদের জীবনের ও চরিত্রের স্থায়ী ভিত্তি। সম্পূর্ণ তলাইয়া তাহার সমস্ত স্তরপর্যায় কেহ আবিষ্কার করিতে পারে না। উপর হইতে যতটা দৃশ্যমান হইয় উঠে, অথবা আকস্মিক ভূমিকম্পবেগে যে নিগুঢ় অংশ উর্দ্ধে উৎক্ষিপ্ত হয় তাহাই আমরা দেখিতে পাই।

 ‘এই মহাদেশেই শস্য পুষ্প ফল সৌন্দর্য ও জীবন অতি সহজে উদ্ভিন্ন হইয়া উঠে। ইহা দৃশ্যতঃ স্থির ও নিক্রিয়; কিন্তু ইহার ভিতরে একটি অনায়াসনৈপুণ্য, একটি গোপন জীবনীশক্তি নিগৃঢ় ভাবে কাজ করিতেছে। সমুদ্র কেবল ফুলিতেছে এবং দুলিতেছে, বাণিজ্যতরী ভাসাইতেছে এবং

৭৬