পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৪

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

গদ্য ও পদ্য

একটা অনাবশ্যক বিচ্ছেদ আনয়ন করিয়াছে; কবি-নামক একটা স্বতন্ত্র জাতির সৃষ্টি করিয়াছে। সম্প্রদায়বিশেষের হস্তে যখন সাধারণের সম্পত্তি অপিত হয়, তখন তাহার স্বার্থ হয় যাহাতে সেটা অন্যের অনায়ত্ত হইয়া উঠে। কবিরাও ভাবের চতুর্দিকে কঠিন বাধা নির্মাণ করিয়া কবিত্ব-নামক একটা কৃত্রিম পদার্থ গড়িয়া তুলিয়াছে। কৌশলবিমুগ্ধ জনসাধারণ বিস্ময় রাখিবার স্থান পায় না। এমনি তাহাদের অভ্যাস বিকৃত হইয়া গিয়াছে যে, ছন্দ ও মিল আসিয়া ক্রমাগত হাতুড়ি না পিটাইলে তাহাদের হৃদয়ের চৈতন্য হয় না, স্বাভাবিক সরল ভাষা ত্যাগ করিয়া ভাবকে পাঁচরঙা ছদ্মবেশ ধারণ করিতে হয়। ভাবের পক্ষে এমন হীনতা আর কিছুই হইতে পারে না। পদ্যটা না কি আধুনিক সৃষ্টি, সেই জন্য সে হঠাং-নবাবের মতো সর্বদাই পেখম তুলিয়া নাচিয়া নাচিয়া বেড়ায়— আমি তাহাকে দু চক্ষে দেখিতে পারিনা।’

 এই বলিয়া ব্যোম পুনর্বার গুড়গুড়ি মুখে দিয়া টানিতে লাগিলেন।

 শ্রীমতী দীপ্তি ব্যোমের প্রতি অবজ্ঞা কটাক্ষপাত করিয়া কহিলেন, ‘বিজ্ঞানে প্রাকৃতিক নির্বাচন বলিয়া একটা তত্ত্ব বাহির হইয়াছে। সেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম কেবল জন্তুদের মধ্যে নহে, মানুষের রচনার মধ্যেও খাটে। সেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবেই ময়ুরীর কলাপের আবশ্যক হয় নাই, ময়ূরের পেখম ক্রমে প্রসারিত হইয়াছে। কবিতার পেখমও সেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফল, কবিদিগের ষড়যন্ত্র নহে। অসভ্য হইতে সভ্য এমন কোন্‌ দেশ আছে যেখানে কবিত্ব স্বভাবতঃই ছন্দের মধ্যে বিকশিত হইয়া উঠে নাই।’

 শ্রীযুক্ত সমীর এত ক্ষণ মৃদুহাস্যমুখে চুপ করিয়া বসিয়া শুনিতেছিলেন। দীপ্তি যখন আমাদের আলোচনায় যোগ দিলেন, তখন তাঁহার মাথায় একটা ভাবের উদয় হইল। তিনি একটা সৃষ্টিছাড়া কথার অবতারণা

৮৪