পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৬

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

গদ্য ও পদ্য

আয়োজন করিতে হইয়াছে। ফুলের প্রত্যেক পাপড়িটিকে কত যত্নে সুগোল সুডোল করিতে হইয়াছে, তাহাকে বৃন্তের উপর কেমন সুন্দর বঙ্কিম ভঙ্গিতে দাঁড় করাইতে হইয়াছে, পর্বতের মাথায় চিরতুষারমুকুট পরাইয়া তাহাকে নীলাকাশের মধ্যে কেমন মহিমার সহিত আসীন করা হইয়াছে, পশ্চিমসমুদ্রতীরের সূর্যাস্তপটের উপর কত রঙের কত তুলি পড়িয়াছে! ভূতল হইতে নভস্তল পর্যস্ত কত সাজসজ্জা, কত রঙচঙ, কত ভাবভঙ্গী, তবে আমাদের এই ক্ষুদ্র মানুষের মন ভুলিয়াছে। ঈশ্বর তাঁহার রচনায় যেখানে প্রেম সৌন্দর্য মহত্ত্ব প্রকাশ করিয়াছেন সেখানে তাঁহাকেও গুণপনা দেখাইতে হইয়াছে। সেখানে তাহাকেও ধ্বনি এবং ছন্দ, বর্ণ এবং গন্ধ বহু যত্বে বিন্যাস করিতে হইয়াছে। অরণ্যের মধ্যে যে ফুল ফুটাইয়াছেন তাহাতে কত পাপড়ির অনুপ্রাস ব্যবহার করিয়াছেন, এবং আকাশপটে একটিমাত্র জ্যোতিঃপাত করিতে তাঁহাকে যে কেমন সুনির্দিষ্ট সুসংযত ছন্দ রচনা করিতে হইয়াছে, বিজ্ঞান তাহার পদ ও অক্ষর গণনা করিতেছে। ভাব প্রকাশ করিতে মানুষকেও নানা নৈপুণ্য অবলম্বন করিতে হয়। শব্দের মধ্যে সংগীত আনিতে হয়, ছন্দ আনিতে হয়, সৌন্দর্য আনিতে হয়, তবে মনের কথা মনের মধ্যে গিয়া প্রবেশ করে। ইহাকে যদি কৃত্রিমতা বলে, তবে সমস্ত বিশ্বরচনা কৃত্রিম।’

 এই বলিয়া স্রোতস্বিনী আমার মুখের দিকে চাহিয়া যেন সাহায্য প্রার্থনা করিল; তাহার চোখের ভাবটা এই, ‘আমি কী কতকগুলা বকিয়া গেলাম তাহার ঠিক নাই, তুমি ঐটেকে আর একটু পরিষ্কার করিয়া বলো না।’

 এমন সময় ব্যোম হঠাৎ বলিয়া উঠিল, ‘সমস্ত বিশ্বরচনা যে কৃত্রিম এমন মতও আছে। স্রোতস্বিনী যেটাকে ভাবের প্রকাশ বলিয়া বর্ণনা করিতেছেন, অর্থাৎ দৃশ্য শব্দ গন্ধ ইত্যাদি, সেটা যে মায়ামাত্র, অর্থাৎ

৮৬