পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/১৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
পথের পাঁচালী
পথের পাঁচালী

—তাহার জন্য একখানা পদ্মপুরাণ কিনিয়া লইয়া যাইবার জন্য। ছেলে বই পড়িতে বড় ভালোবাসে-মাঝে মাঝে সে যে বাপের বাক্স-দপ্তর হইতে লুকাইয়া বই বাহির করিয়া লইয়া পড়ে, তাহা হরিহর বুঝিতে পারে-বাক্সের ভিতর আনাড়ি হাতের হেলাগোছা করা থাকে– কোন বই বাবা বাক্সর কোথায় রাখে, ছেলে তোহা জানে না-উলটা-পালটা করিয়া সাজাইয়া চুরি ঢাকিবার অক্ষম চেষ্টা করে—হরিহর বাড়ি ফিরিয়া বাক্স খুলিয়াই বুঝিতে পারে ছেলের কীর্তি।

তাহার বাড়ি হইতে আসিবার পূর্বে তুরিহর যুগীপাড়া হইতে একখানা বটতলার পদ্মপুরাণ পড়িবার জন্য লইয়া আসে-অপু বইখানা দখল করিয়া বসিল—রোজ রোজ পড়ে—কুচুনী পাড়ায় শিবঠাকুরের মাছ ধরিতে যাওয়ার কথাটা পড়িয়া তাহার ভারি আমোদ-হরিহর বলে-বইখানা দ্যাও বাবা, যাদের বই তারা চাচ্ছে যে! অবশেষে একখানা পদ্মপুরাণ তাঁহাকে কিনিয়া দিতে হইবেএই শর্তে বাবাকে রাজি করাইয়া। তবে সে বই ফেরত দেয়। আসিবার সময় বার বার বলিয়াছে।– সেই বই একখানা এনে কিন্তু বাবা, এবার অবিশ্যি অবিশ্যি। দুর্গার উঁচু নজর নাই, সে বলিয়া দিয়াছে, একখানা সবুজ হাওয়াই কাপড় ও একপাত ভালো দেখিয়া আলতা লইয়া যাইবার জন্য। কিন্তু সে সব তো দূরের কথা, কি করিয়া বাড়িতে সংসার চলিতেছে সেই না এখন সমস্যা! সন্ধ্যার পর পূর্ব-পরিচিত কাঠের গোলটায় গিয়া সে রাত্রের মতো আশ্রয় লইল। ভালো ঘুম হইল নাবিছানায় শুইয়া বাড়িতে কি করিয়া কিছু পাঠায় এই ভাবনায় এপাশ-ওপাশ করিতে লাগিল।

সকালে উঠিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে সে লক্ষ্যহীন ভাবে পথের একস্থানে দাঁড়াইল। রাস্তার ওপারে। একটা লাল ইটের লোহার ফটকওয়ালা বাড়ি। অনেকক্ষণ চাহিয়া তাহার কেমন মনে হইল। এই বাড়িতে গিয়া দুঃখ জানাইলে তাহার একটা উপায় হইবে। কলের পুতুলের মতো সে ফটকের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। সাজানো বৈঠকখানা, মার্বেল পাথরের ধাপে স্তরে স্তরে বসানো ফুলের টব, পাথরের পুতুল, পাম, দরজায় ঢুকিবার স্থানে পা-পোষ পাতা। একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক বৈঠকখানায় খবরের কাগজ পড়িতেছেন-অপরিচিত লোক দেখিয়া কাগজ পাশে রাখিয়া সোজা হইয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কে তুমি? কি দরকার?

হরিহর বিনীতভাবে বলিল-আজ্ঞে আমি ব্ৰাহ্মণ-সংস্কৃত পড়া আছে, চণ্ডী পাঠ-টাট্‌ করি।– তা ছাড়া ভাগবত কি গীতা পাঠও–

প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি ভালো করিয়া কথা না শুনিয়াই তাহার সময় অত্যন্ত মূল্যবান, বাজে কথা শুনিবার সময় নিতান্ত সংক্ষেপ জানাইয়া দিবার ভাবে বলিলেন-না, এখানে ওসব কিছু এখন সুবিধে হবে না, অন্য জায়গায় দেখুন।

হরিহর মরীয় ভাবে বলিল-আজ্ঞে নতুন শহরে এসেচি, একেবারে কিছু হাতে নেই-বড় বিপদে পড়িচি, কদিন ধরে কেবলই–

প্রৌঢ় লোকটি তাড়াতাড়ি বিদায় করিবার ভঙ্গিতে ঠেস দেওয়ার তাকিয়াটা উঠাইয়া একটা কি তুলিয়া লইয়া হরিহরের দিকে হাত বাড়াইয়া বলিলেন–এই নিন, যান, অন্য কিছু হবে টবে না, নিন।