পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/১৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
১৫২
পথের পাঁচালী

এসো। স্ত্রীর অদৃষ্টপূর্ব শাস্তাভাব হরিহর লক্ষ করিলেও তাহার মনে কোনো খটকা হইল না।–তাহার কল্পনার স্রোত। তখন উদ্দাম বেগে অন্যদিকে ছুটিয়াছে-এখনই ছেলে মেয়ে ছুটিয়া আসিবে–দুৰ্গা আসিয়া হাসিমুখে বলিবে-কি বাবা এর মধ্যে? আমনি তাড়াতাড়ি হরিহর পুঁটুলি খুলিয়া মেয়ের কাপড় ও আলতার পাতা এবং ছেলের সচিত্র ‘চণ্ডী-মাহাত্ম্য বা কালকেতুর উপাখ্যান’ ও টিনের রেলগাড়িটা দেখাইয়া তাঁহাদের তাক লোগাইয়া দিবে। সে ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে বলিল, বেশ কঁঠালের চাকি-বেলুন। এনিচি এবার। পরে কিছু নিরাশামিশ্রিত সতৃষ্ণ নয়নে চারিদিকে চাহিয়া বলিল, কই—অপু দুগগা এরা বুঝি সব বেরিয়েচে–

সর্বজয়া আর কোনো মতেই চাপিতে পারিল না। উচ্ছসিত কণ্ঠে ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিল– ওগো দুগগা কি আর আছে গো-মা যে আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েচে গো-এতদিন কোথায় ছিলে!

গাঙ্গুলি-বাড়ির পূজা অনেক কালের। এ কয়দিন গ্রামে অতি বড় দরিদ্রও আভুক্ত থাকে না। সব বনেদী বন্দোবস্ত, নির্দিষ্ট সময়ে কুমোর আসিয়া প্রতিমা গড়ায়, পোটো চালচিত্র করে, মালাকার সাজ জোগায়, বারাসে-মধুখালির দ’ হইতে বাউরিরা রাশি রাশি পদ্মফুল তুলিয়া আনে।

আঁসামালির দীনুসানাইদার অন্য অন্য বৎসরের মতো রসুনোচৗকি বাজাইতে আসিল। প্ৰভাতের আকাশে আগমনীর আনন্দ সুর বাজিয়া ওঠে-আসন্ন হেমন্ত ঋতুর মেহত্মভ্যর্থনা-নব ধান্যগুচ্ছের, নব আগন্তুক শেফালিদলের, হিমালয়ের পার হইতে উড়িয়া আসা পথিক-পাখি শ্যামার, শিশির-স্নিগ্ধ মৃণাল-ফোটা হেমন্তসন্ধ্যার।

নূতন কাপড় পরাইয়া ছেলেকে সঙ্গে লইয়া হরিহর নিমন্ত্রণ খাইতে যায়। একখানি অগোছালো চুলে-ঘেরা ছোট মুখের সনির্বন্ধ গোপন অনুরোধ দুয়ারের পাশের বাতাসে মিশাইয়া থাকে-হরিহব পথে পা দিয়া কেমন অন্যমনস্ক হইয়া পড়ে-ছেলেকে বলে, এগিয়ে চলো, অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে বাবা–

গাঙ্গুলি-বাড়ির প্রাঙ্গীণ উৎসবেশে সজ্জিত হাসিমুখ ছেলেমেয়েতে ভরিয়া গিয়াছে। অপু চাহিয়া দেখিল, সতু ও তাহার ভাই কেমন কমললেবু রং-এর জামা গায়ে দিয়াছো-সবুজ শাড়ি পরিয়া ও দিব্য চুল বাঁধিয়া রানু দিদিকে যা মানাইয়াছে! গাঙ্গুলি বাড়ির মেয়ে সুনয়নী খোঁপায় রজনীগন্ধা ফুল গুজিয়া আর পাঁচ-ছয়টি মেয়ের সঙ্গে পূজার দালানে দাঁড়াইয়া খুব গল্প করিতেছে ও হাসিতেছে। সুনয়নী বাদে বাকি মেয়েদের সে চেনে না, বোধ হয় অন্য জায়গা হইতে উহাদের বাড়ি পূজার সময় আসিয়া থাকিবে-শহরের মেয়ে বোধ হয়, যেমন সাজগোজ, তেমন দেখিতে! অপু একদৃষ্টি তাহদের দিকে চাহিয়া রহিল। ওদিকে কে চেঁচাইয়া বলিতেছে-বড় সামিয়ানাটা আনবার ব্যবস্থা এখনও হল না?—বাঃ-তোমাদের যা কাজ-কর্ম দেখো এখন এর পর মজাটা। তারপর ব্রাহ্মণ। খেতে বসবে কি বোলা পাঁচটায়?