পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/১৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
পথের পাঁচালী
১৬৫

তুলিয়া নির্জনে দেশের দুর্দশা চিন্তা করে। দিনের পর দিন এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে তাহার নিম্পাপ কুমারী-মনে উদয় হইল কে তাহাকে বলিতেছে-তুমি ফ্রান্সের রক্ষাকত্রী, তুমি গিয়া রাজসৈন্য জড়ো করো, অস্ত্র ধরো, দেশের জাতির পরিত্রামের ভার তোমার হাতে। দেবী মেরী তাহার উৎসাহদাত্রী-দূর স্বৰ্গ হইতে তাঁহার আহ্বান আসে দিনের পর দিন। তারপর নব্বতেজোদৃপ্ত ফরাসি সৈন্যবাহিনী কি করিয়া শত্রুদলকে দেশ হইতে তাড়াইয়া দিল, কি করিয়া ভাবময়ী কুমারী নিজে অস্ত্র ধরিয়া দেশের রাজাকে সিংহাসনে বসাইলেন, তাব।পর অজ্ঞানান্ধ লোকে কি করিয়া তাহাকে ডাইনি অপবাদে জীবন্ত পুড়াইয়া মারিল, এ সকল কথাই সে আজ পড়িয়াছে।

এই বৈকাল বেলাটাতে, এই শান্ত নদীর ধারে গল্পটি ভাবিতে ভাবিতে কি অপূর্ব ভাবেই তাহার মন পূর্ণ হইয়া যায়!-কুমারীর যুদ্ধের কথা, জয়ের কথা, অন্য সব কথা সে তত ভাবে না। কিন্তু যে ছবিটি তাহার বার বার মনে আসে, তাহা শুধু নির্জন প্রান্তরে চিন্তারতা বালিকা আর চারিধারে যাদৃচ্ছিবিচরণশীল মেষদল, নিম্নে শ্যাম তৃণভূমি, মাথার উপর মুক্ত নীল আকাশ। একদিকে দুর্ধর্ষ বৈদেশিক শত্ৰু, নিষ্ঠুরতা, জয়লালসার দপ, রক্তস্রোত,-অপরদিকে এক সরলা, দিব্য ভাবময়ী নীলনীযনা পল্লীবালিকা। ছবিটা তাহার প্রবর্ধমান বালকমনকে মুগ্ধ করিয়া দেয়।

আরও ছবি মনে আসে। কতদূরের নীল-সমুদ্র-ঘেরা মাটিনিক দ্বীপ। চারিদিকে আখের খেত, মাথার উপর নীল আকাশ-বহু-বহু দূর-শুধু নীল আকাশ আর নীল সমুদ্র!—শুধু নীল আর নীল! আরও কত কি, তাহা বুঝানো যায় না-বলা যায় না।

ছিপ গুটাইয়া সে বাড়ির দিকে যাইবার জোগাড় করে। নদীর ধারে ধারে নতশীর্ষ বাবলা ও সাইবাবলার বন নদীর স্নিগ্ধ কালো জলে ফুলের ভার ঝরাইয়া দিতেছে। সোনাডাঙা মাঠের মাঝে ঠাঙাড়ে বটগাছটার আড়ালে প্ৰকাণ্ড রক্তবর্ণ সূর্য হেলিয়া পড়িয়াছে’-যেন কোন দেবশিশু অলকার জুলন্ত ফেনিল সোনার সমুদ্র হইতে ফু দিয়া একটা বুদ্ধৃদ তুলিয়া খেলাচ্ছলে আকাশে উড়াইয়া দিয়াছিল, এইমাত্র সেটা পশ্চিম দিগন্তে পৃথিবীর বানান্তরালে নামিয়া পড়িতেছে!

পিছন হইতে কে তাহার চোখ টিপিয়া ধরিল। সে জোর করিয়া হাত দিয়া চোখ ছাড়াইয়া লাইতেই পটু খিলখিল করিয়া হাসিয়া সামনে আসিয়া বলিল-তোকে খুঁজে খুঁজে কোথাও পাইনে অপুদা, তারপল ভাবলাম তুই ঠিক মাছ ধর্তে এইছিস, তাই এলাম। মাছ হয়নি?…একটাও না? চল বরং একখানা নৌকা খুলে নিয়ে বেড়িয়ে আসি –যাবি?

কদমতলায় সাহেবের ঘাটে অনেক দূরদেশ হইতে নৌকা আসে,–গোলপাতা-বোঝাই, ধানবোঝাই, ঝিনুক-বোঝাই নৌকা সারি সারি বাঁধা। নদীতে জেলেদের ঝিনুক-তোলা নৌকায় বড় জাল ফেলিয়াছে। এ সময় প্রতি বৎসরই ইহারা দক্ষিণ হইতে ঝিনুক তুলিতে আসে; মাঝ নদীতে নৌকায় নৌকায় জোড়া দিয়া দাঁড় করিয়া রাখিয়াছে। অপু ডাঙায় বসিয়া দেখিতেছিল,—একজন কলোমতো লোক বার বার ড়ুব দিয়া ঝিনুক খুঁজতেছে ও অল্পীক্ষণ পরে নৌকার পাশে উঠিয়া হাতের থলি হইতে