পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/১৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
পথের পাঁচালী
১৭৫

পরদিন সন্ধ্যার কিছু আগে আহারাদি সারিয়া অপু গোয়ালাপাড়ার দিকে চলিল। আগেব দিন তাহার পিসেমশায় ঠিক করিয়া দিয়াছে। এ গ্রাম হইতে নবাবগঞ্জে তামাক বোঝাই গাড়ি যাইবে, সেই গাড়িতে উঠিয়া সন্ধ্যার সময় রওনা হইলে সকালের দিকে নিশ্চিন্দিপুরের পথে তাহাকে উহারা নামাইয়া দিবে।

অল্পদূরে গিয়া বামুনপাড়ার পথের মোড়ে গুলকীর সঙ্গে দেখা। সে সন্ধ্যায় খেলা করিয়া বাড়ি ফিরিতেছে। অপু বলিল-বাড়ি চলে যাচ্ছি রে খুকি। আজ-সারাদিন ছিলি কোথায়? খেলতে এলিনে কিছু না-। পরে গুলকী অবিশ্বাসের হাসি হাসিতেছে দেখিয়া বলিল-সত্যি রে, সত্যি বলচি, এই দ্যাখ পুটলি, কার্তিক গোয়ালার বাড়ি গিয়ে গাড়ি উঠবো-আয় না। আমার সঙ্গে একটু এগিয়ে দিবি?

গুলকী পিছনে পিছনে অনেকদূর চলিল। বামুনপাড়া ছাড়িয়া খানিকটা ফাকা মাঠ। তাহার পরেই গোয়ালাপাড়া। গুলকী মাঠের ধার পর্যন্ত আসিল। অপুর রাঙা সাটিনের জামটার দিকে আঙুল দেখাইয়া কহিল-তোমার এই আঙা জামাটা ক’পয়সা?

অপু হাসিমুখে বলিল-দুটাকা-তুই নিবি?

গুলকী ফিক্‌ করিয়া হাসিল। অর্থাৎ তুমি যদি দাও, এখখনি..

হঠাৎ সামনের পথে চোখ ফিরাইতেই অপু দেখিতে পাইল, মাঠের শেষে গাছপালার ফাকে আলো হইয়া উঠিয়াছে।—অমনি কেমন করিয়া তাহার মনে হইল আগামী মাসের এমন দিনটাতে তাহারা কোথায় কতদূরে চলিয়া যাইবে। পরে গুলকীকে বলিল-আর আসিস নে খুকি, তুই চলে যা-অনেকদূরে এসে গিাইচিস-তোর বাড়িতে হয়তো আবার বকবে-চলে যা খুকি।-আবার এলে দেখা হবে, কেমন তো? হয়তো আর আসবো না, আমরা কাশী চলে যাবো বোশেখ মাসে, সেখানে বাস করবো-গুলকী আর একবার ফিক করিয়া হাসিল।

সেদিন পূর্ণিমা কি চতুর্দশী এমনি একটা তিথি। সে এদিকে আর কখনও আসে নাই, কিন্তু বাল্যের এই এক প্রথম বিদেশ-গমন সম্পর্কিত একটা ছবি অনেক দিন পর্যন্ত তাহার মনে ছিল— সোজা মাঠের পথে দূর-প্রান্তে গাছপালার ফাঁকে পূর্ণচন্দ্র উঠিতেছে (বা চতুর্দশীর চন্দ্র, তাহার ঠিক মনে ছিল না।) পিছনে পিছনে অল্পদিনের পরিচিতা, অনাথা, অবোধ কাঁকড়াচুল ছোট একটি মেয়ে তাহাকে আগাইয়া দিতে আসিয়াছে।



পথের পাঁচালী
ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ

বৈশাখ মাসের প্রথমে হরিহর নিশ্চিন্দিপুর হইতে বাস উঠাইবার সব ঠিক করিয়া ফেলিল। যে জিনিসপত্র সঙ্গে করিয়া লইয়া যাওয়া চলিবে না, সেগুলি বিক্রয় করিয়া ফেলিয়া নানা খুচরা দেনা শোধ দিয়া দিল। সেকালের কাঁঠালকাঠের বড় তক্তপোশ, সিন্দুক, পিঁড়ি ঘরে অনেকগুলি ছিল, খবর পাইয়া ওপাড়া হইতে পর্যন্ত খরিদ্দার আসিয়া সস্তাদরে কিনিয়া লইয়া গেল।