পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২০
পথের পাঁচালী

কহিল—শোনো না দাসীপিসি, আমি একটা পয়সা দেবো এখন, পুতুলের বাক্সে আছে, মা ঘরে চাবি দিয়ে ঘাটে গেল, এলে নুকিয়ে দেবো এখন, মাকে বোলো না যেন পিসি।

 দুপুরের কিছু পূর্বে ইন্দির বুড়ি বাড়ি হইতে বাহির হইয়া যাইতেছে। বা ঁহাতে ছোট একটা ময়লা কাপড়ের পুটুলি, ডানহাতে পিতলের চাদরের ঘটিটা বুলানো, বগলে একটা পুরোনো মাদুর, মাদুরের পাড় ছিড়িয়া কাঠিগুলি বুলিতেছে।

 খুকি। বলিল, ও পিসি, যাসনে—ও পিসি কোথায় যাবি? পরে সে ছুটে আসিয়া মাদুরের পিছনটা টানিয়া ধরিল। তুই চলে গেলে আমি কাঁদবো পিসি—ঠিক—

 সর্বজয়া ঘরের দাওয়া হইতে বলিল, তা যাবে যাও, গোরস্তর অকল্যাণ করে যাওয়া কেন? ছেলেপিলে নিয়ে ঘর করি, এতকাল যার খেলে তার একটা মঙ্গল তো দেখতে হয়, অনখ সময়ে না খেয়ে চলে গিয়ে তারপর গোরস্তর একটা অকল্যেণ বাধুক, এই তোমার ইচ্ছে তো? ওই রকম কুচকুরে মন না হলে কি আর এই দশা হয়?…

 বুড়ি ফিরিল না। খুকি। কাঁদিতে কাঁদিতে অনেক দূর পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে গেল।

 বুড়ি গিয়া গ্রামের ও-পাড়ার নবীন ঘোষালের বাড়ি উঠিল। নবীন ঘোষালের বউ সব নিয়া গালে হাত দিয়া বলিল-ওমা, এমন তো কখনও শুনিনি, হ্যাগো খুড়ি? তা থাকো মি, এইখানেই থাকো।

 মাস-দুই সেখানে থাকার পর বুড়ি সেখান হইতে বাহির হইয়া তিনকড়ি ঘোষালের বাড়ি ও তথা হইতে পূর্ণ চক্রবর্তীর বাড়ি আশ্রয় লইল। প্রত্যেক বাড়িতেই প্রথম আপ্যায়নের হৃদ্যতটুকু কিছুদিন পর উবিয়া যাওয়ার পরে বাড়ির লোকে নানা রকমে বিরক্তি প্রকাশ করিত। পরামর্শ দিত ঝগড়া মিটাইয়া ফেলিয়া বাড়ি ফিরিয়া যাইতে। বুড়ি আরও দু’এক বাড়ি ঘুরিল, সব সময়ই তাহার ভরসা ছিল বাড়ি হইতে আর কেহ না হয়, অন্তত হরিহর ডাকিয়া পাঠাইবে। কিন্তু তিনমাস হইয়া গেল, কেহই আগ্রহ করিয়া ডাকিতে আসিল না। দুর্গাঁও আসে নাই। বুড়ি জানে ও-পাড়া হইতে এ-পাড়া অনেক দূরে, ছোট মেয়ে এতদূর আসিতে পারে না। সে আশায় আশায় ও-পাড়ায় দু’একবার গেল, খুকির সঙ্গে দেখা হইল না।

 বারো মাস লোকের বাড়ি আশ্রয় হয় না। পুব-পাড়ার চিন্তে গয়লানীর চালা ঘরখানি পড়িয়া ছিল—মাস দুই পরে সকলে মিলিয়া সেই ঘরখানি বুড়ির জন্য ঠিক করিয়া দিল এবং ঠিক করিল পাড়া হইতে সকলে কিছু কিছু সাহায্য করিবে। ঘরখানা নিতান্ত ছোট, ছিটে বেড়ার দেয়াল, পাড়া হইতে দূরে, একটা বাঁশবনের মধ্যে। লোকের মুখে শুনিত সর্বজয়া নাকি বলিয়াছে—তেজ দেখুক পাঁচজনে। এ বাড়ি আর না, আমার বাছাদের মুখের দিকে যে তাকায়নি—তাকে আর আমার দোরে মাথা গলাতে হবে না, ভাগাড়ে পড়ে মরুক গিয়ে।যাহাদের সাহায্য করিবার কথা ছিল, তাহারা প্রথম দিনকতক খুব উৎসাহের সঙ্গে জোগাইল, ক্রমে কিন্তু তাহাদের আগ্রহও কিমিয়া গেল। বুড়ি ভাবে, কেন সেদিন অত রাগ করে চলে এলাম? বেী বারণ কল্লে, খুকি। কত কাঁদলে, হাতে ধরে টানাটানি কল্লে—! নিজের উপর