পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২
পথের পাঁচালী

-খোঁড়া কাপড় দু’খানা ও ময়লা গামছাখানা বাঁধিয়া বুড়ি বাড়ির দিকে চলিল। পথে গোপী বোষ্টমের বৌ বলিল, দিদি ঠাকরুন, তা বাড়ি যােচ্ছ বুঝি?? বৌদিদির রাগ চলে গিয়েছে বুঝি?

 বুড়ি একগাল হাসিল, বলিল–কাল দুৰ্গা যে সন্দে বেলা ডাকতে গিয়েছিল, কত কাঁদলে, বল্লে, মা বলেচে-চ’ পিসি বাড়ি চ’—তা আমি বল্লাম–আজ তুই যা, কাল সক্কাল বেলাডা হোক, আমি বাড়ি গিয়ে উঠবো।–মেয়ের আমার কত কান্না, যেতে কি চায়!..তাই সকালে যাচ্ছি।

 বুড়ি ঢুকিয়া দেখিল কেহ বাড়ি নাই। কাল সারারাত জ্বর ভোগের পর এতটা পথ রৌদ্রে দুর্বল শরীরে আসিয়া বোধ হয় অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, পুটুলিটা নামাইয়া সে নিজের ঘরের দাওয়ার পৈঠায় বসিয়া পড়িল।

 একটু পরেই খিড়কি দোর ঠেলিয়া সর্বজয়া স্নান করিয়া নদী হইতে ফিরিল। এদিকে চোখ পড়িলে বুড়িকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সে বিস্ময়ে নির্বাক হইয়া একটুখানি দাঁড়াইল বুড়ি হাসিয়া বলিল–ও বৌ, ভালো আছিস? এই অ্যালাম অ্যাদ্দিন পরে, তোদের ছেড়ে আর কোথায় যাবো এ বয়সে–তাই বলি–

সর্বজয়া আগাইয়া আসিয়া বলিল–তুমি এ বাড়ি কি মনে করে?

তার ভাবভঙ্গি ও গলার স্বরে বুড়ির হাসিবার উৎসাহ আর বড় রহিল না। সর্বজয়া কথার উত্তর দিতে না দিয়াই বলিল–এ বাড়ি আর তোমার জায়গা কিছুতেই হবে না– সে তোমাকে আমি সেদিন বলে দিয়েচি–ফের কোন মুখে এয়েচ?

বুড়ি কাঠের মতো হইয়া গেল, মুখ দিয়া আর কোন কথা বাহির হইল না। পরে সে হঠাৎ একেবারে কাঁদিয়া বলিল–ও বৌ, আমন করে বলিসনে–একটুখানি ঠাই দে আমারে–কোথায় যাবো। আর শেষকালডা বল দিকিনি—তবু এই ভিটেটাতে–

–ন্যাও, আর ভিটের দোহাই দিতে হবে না, ভিটের কল্যাণ ভেবে তোমার তো ঘুম নেই, যাও এক্ষুনি বিদেয় হও, নইলে অনাথ বাধাবো–

ব্যাপার এরূপ দাঁড়াইবে বুড়ি বোধ হয় আদৌ প্রত্যাশা করে নাই। জলমগ্ন ব্যক্তি যেমন ডুবিয়া যাইবার সময় যাহা পায় তাহাই আঁকড়াইয়া ধরিতে চায়, বুড়ি সেইরূপ মুঠা আঁকড়াইয়া আশ্রয় খুজিতে লক্ষ্যহীন ভাবে এদিক ওদিক চাহিল–আজ তাহার কেমন মনে হইল যে, বহুদিনের আশ্রয় সত্য সত্যই তাহার পায়ের তলা হইতে সরিয়া যাইতেছে, আর তাহাকে ধরিয়া রাখিবার উপায় নাই।

সর্বজয়া বলিল–যাও আর বসে থেকে না ঠাকুরঝি, বেলা হয়ে যাচ্ছে আমার কাজকর্ম আছে, এখানে তোমার জায়গা কোনোরকমে দিতে পারবো না–

বুড়ি পুঁটুলি লইয়া অতিকষ্টে আবার উঠিল। বাহির দরজার কাছে যাইতে তাহার নজর পড়িল তাহার উঠান-ঝাঁটের ঝাঁটাগাছটা পাঁচিলের কোণে ঠেস দেওয়ানো আছে, আজ তিন-চারি মাস তাহাতে কেহ হাত দেয় নাই। এই ভিটার ঘাসটুকু, ওই কত যত্নে পোঁতা লেবু গাছটা, এই অত্যন্ত প্রিয়