পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
পথের পাঁচালী
পথের পাঁচালী

নবীন পালিত বলিল, বরং এক কাজ করো। হরি, মাছ যদি ধরতে হয়, তবে বঁয়াশার বিলে একদিন চলে যাওয়া যাক-পুব-পাড়ার নেপাল পাড়ই বাচ দিচ্ছে, রোজ দেড়মন দু’মিন এইরকম পড়চে-পাঁচ-সেরের নিচে মাছ নেই!! শুনলাম, একদিন শেষরাত্তিরে নাকি বিলের একেবারে মধ্যিখানে অর্থই জলে সৗ সা করে ঠিক যেন বকনা বাছুরের ডাক–বুঝলে?

সকলে একসঙ্গে আগাইয়া আসিয়া নবীন পালিতের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

–অনেক—কেলে পুরোনো বিল, গহিন জল, দেখেছো তো মধ্যিখানে জল যেন কালো শিউগোলা, পদ্মগাছের জঙ্গল, কেউ বলে রাঘব বোয়াল, কেউ বলে যক্ষি–যতক্ষণ ফরাসা না হলো ততক্ষণ তো মশাই নৌকোর ওপর সকলে বসে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলো–

বেশ জমিয়া আসিয়াছে, হঠাৎ হরিহরের ছেলেটি মহা-উৎসাহে পাশের এক উলুখড়ের ঝোপের দিকে আঙুল তুলিয়া চিৎকার করিতে করিতে ছুটিয়া গেল।–ওই যাচ্ছে বাবা, দ্যাখো বাবা, ওই গেল বাবা, বড় বড় কান, ওই–

তাহার বাবা পিছন হইতে ডাক দিয়া বলিল,–উঁহু উঁহু উঁহু–কাঁটা কাঁটা কাঁটা-পরে তাড়াতাড়ি আসিয়া খপ করিয়া ছেলের হাতখানি ধরিয়া বলিল,–আঃ বড্ড বিরক্ত কল্লে দেখচি তুমি, একশ’ বার বারণ কিচ্চি তা তুমি কিছুতেই শুনবে না, ওই জন্যেই তো আনতে চাচ্ছিলাম না।

বালক উৎসাহে ও আগ্রহে উজ্জ্বল মুখ উঁচু করিয়া বাবার দিকে তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল–কি বাবা?

হরিহরি বলিল–কি তা কি আমি দেখেচি! শুওর-টুওর হবে।–নাও চলো, ঠিক রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটো–

–শুওর না বাবা, ছোট্ট যে! পরে সে নিচু হইয়া দৃষ্ট বস্তুর মাটি হইতে উচ্চতা দেখাইতে গেল।

–চল চল––হ্যাঁ–আমি বুঝতে পেরেচি, আর দেখাতে হবে না-চল দিকি!…

নবীন পালিত বলিল–ও হলো খরগোশ, খোকা খরগোশ। এখানে খড়ের ঝোপে। খরগোশ থাকে, তাই।

বালক বর্ণপরিচয়ে ‘খ’-এ খরগোশের ছবি দেখিয়াছে, কিন্তু তাহা যে জীবন্ত অবস্থায় এ রকম লাফাইয়া পালায় বা তাহা আবার সাধারণ চক্ষুতে দেখিতে পাওয়া যায়, এ কথা সে কখনও ভাবে নাই।

খরগোশ!–জীবন্ত–একেবারে তোমার সামনে লাফাইয়া পালায়–ছবি না, কাচের পুতুল না–একেবারে কানখাড়া সত্যিকারের খরগোশ! এইরকম ভাটগাছ। বৈঁচিগাছের ঝোপে।–জল-মাটির তৈরি নশ্বর পৃথিবীতে এ ঘটনা কি করিয়া সম্ভব হইল, বালক তাহা কোনমতেই ভাবিয়া ঠাহর করিতে পারিতেছিল না।

সকলে বনে ঘেরা সরু পথ ছাড়াইয়া মাঠে পড়িল। নদীর ধারের বাবলা ও জিওল গাছের আড়ালে একটা বড় ইটের পাঁজার মতো জিনিস নজরে পড়ে, ওটা পুরানো কালের লকুঠির জ্বালঘরের ভগ্নাবশেষ। সেকালে নীলকুঠির আমলে এই নিশ্চিন্দিপুর বেঙ্গল ন্ডিগো কনসারনের হেড কুঠি ছিল,