পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৩৬
পথের পাঁচালী

অপু বলিল–উঃ, অনেক রে দিদি!–একটা কঞ্চি দিয়ে পাড়া যায় না?

দুৰ্গা বলিল-তুই এক কাজ কর, ছুটে গিয়ে বাড়ির মধ্যে থেকে আঁকুশিটা নিয়ে আয় দিকি? আঁকুশি দিয়ে টান দিলে পড়ে যাবে দেখিস এখন–

অপু বলিল–তুই এখানে দাঁড়া দিদি, আমি আনচি–

অপু আঁকুশি আনিলে দুজনে মিলিয়া বহু চেষ্টা করিয়াও চার-পাঁচটার বেশি ফল পাড়িতে পারিল না–খুব উচুগাছ, সর্বোচ্চ ডালে যে ফল আছে তাহা দুৰ্গা আঁকুশি দিয়াও নাগাল পাইল না। পরে সে বলিল–চল আজ। এইগুলো নিয়ে যাই, নাইবার বেলায় মাকে সঙ্গে আনবো–মার হাতে ঠিক নাগাল আসবে। দে নোনাগুলো আমার কাছে, তুই আঁকুশিটা নে। নোলক পরবি?

একটা নিচু ঝোপের মাথায় ওড়কলমি লতায় সাদা সাদা ফুলের কুড়ি, দুৰ্গা হাতের ফলগুলো নামাইয়া নিকটের ফুলের কুড়ি ছিড়িতে লাগিল। বলিল–এদিকে সরে আয়, নোলক পড়িয়ে দি–

তাহার দিদি ওড়কলমি ফুলের নোলক পরিতে ভালোবাসে, বনজঙ্গল সন্ধান করিয়া সে প্রায়ই খুজিয়া আনিয়া নিজে পড়ে ও ইতিপূর্বে কয়েকবার অপুকেও পরাইয়াছে। অপু কিন্তু মনে মনে নোলক-পরা পছন্দ করে না। তাহার ইচ্ছা হইল, বলে, নোলকে তাহার দরকার নাই। তবে দিদির ভয়ে সে কিছুই বলিল না। দিদিকে চটাইবার ইচ্ছা তাহার আদৌ নাই, কারণ দিদিই। বনজঙ্গল ঘুরিয়া কুলটা, জামটা, নোনাটা, আমড়াটা সংগ্ৰহ করিয়া তাহাকে লুকাইয়া খাওয়ায়, এমন সব জিনিস জুটাইয়া আনে, যাহা হয়তো কুপথ্য হিসাবে উহাদের খাইতে নিষেধ আছে, কাজেই অন্যায় হইলেও দিদির কথা না শুনা তাহার সাহসে কুলায় না।

একটা কুড়ি ভাঙিয়া সাদা জলের মতো যে আঠা বাহির হইল, তাহার সাহায্যে দুৰ্গা অপুর নাকে কুড়িটি আঁটিয়া দিল, পরে নিজেও একটা পরিল–তারপর ভাইয়ের চিবুকে হাত দিয়া নিজের দিকে ভালো করিয়া ফিরাইয়া বলিল–দেখি, কেমন দেখাচ্ছে? বাঃ বেশ হয়েচে, চল মাকে দেখাইগে–

অপু লজ্জিতমুখে বলিল–না দিদি—

–চল না–খুলে ফেলিসনে যেন।–বেশ হয়েচে–

বাড়ি আসিয়া দুৰ্গা নোনাফলগুলি রান্নাঘরের দাওয়ায় নামাইয়া রাখিল। সর্বজয়া রাঁধিতেছিল––দেখিয়া খুব খুশি হইয়া বলিল–কোথায় পেলি রে?

দুৰ্গা বলিল–ওই লিচু-জঙ্গলে–অনেক আছে, কাল গিয়ে তুমি পাড়বে মা? এমন পাকা-একেবারে সিদুরের মতো রাঙা–

সে আড়াল ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া বলিল–দ্যাখো মা–

অপু নোলক পরিয়া দিদির পিছনে দাঁড়াইয়া আছে। সর্বজয়া হাসিয়া বলিল–ও মা! ও আবার কে রে?–কে চিনতে তো পারছি নে–

অপু লজ্জায় তাড়াতাড়ি নাকের ডগা হইতে ফুলের কুড়ি খুলিয়া ফেলিল। বলিল–ওই দিদি পরিয়ে দিয়েছে–