পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
পথের পাঁচালী
পথের পাঁচালী

গুটিতে নাম লেখা না-হয় নেই-ই, তোমাদের কোন বাগান থেকে এগুলো এসেচে। তা বলতে পারো? বলি টাকাগুলোতেও তো নাম লেখা ছিল না।—তা তো হাত পেতে নিতে পেরেছিলে? আজ এক বিচ্ছরের ওপর হয়ে গ্যালো, আজ দেবো কাল দেবো।—আসবো এখন ওবেলা, টাকা দিয়ে দিয়ো—ও আমি আর রাখতে পারবো না— টাকার জোগাড় করে রেখো বলে দিচ্চি।

দলবলসহ সেজ-ঠাকরুন দরজার বাহির হইয়া গেলেন। সর্বজয়া শুনিতে পাইল, পথে কাহার কথার উত্তরে তিনি বেশ উচ্চকণ্ঠেই বলিতেছেন-ওই এ-বাড়ির ছুড়িটা, টুনুর বাক্স থেকে এই পুতির মালাছড়াটা চুরি করে নিয়ে গিয়ে করেচে। কি নিজের বাক্সে লুকিয়ে রেখেচে—আর দ্যাখো না। এই আমগুলো—পাশেই বাগান, যত ইচ্ছে পাড়লেই হল—তাই বলতে গেলাম, তা মা আবার কেটে কেটে বলচে (এখানে সেজ-বৌ সর্বজয়ার কথা বলিবার ভঙ্গি নকল করিলেন)—তা—এনেচে ছেলেমানুষ— ও রকম এনেই থাকে-ওতে কি তোমাদের নাম লেখা আছে নাকি? (সুর নিচু করিয়া) মা-ই কি কম চোর নাকি, মেয়ের শিক্ষে কি আর অমনি হয়েচে? বাড়িসুদ্দ সব চোর—

অপমানে দুঃখে সর্বজয়ার চোখে জল আসিল। সে ফিরিয়া দুর্গার রুক্ষ চুলের গোছা টানিয়া ধরিয়া ডাল ভাত মাখা হাতেই দুড়দাড় করিয়া তাহার পিঠে কিলের উপর কিল ও চড়ের উপর চড় মারিতে মারিতে বলিতে লাগিল—আপদবালাই একটা কোথেকে এসে জুটেছে—ম’লে ও আপদ চুকে যায়—মরেও না যে বাঁচি-হাড় জুড়োয়।—বেরো বাড়ি থেকে, দূর হয়ে যা—যা, এখখুনি বেরো—

দুর্গা মারা খাইতে খাইতে ভয়ে খিড়কি-দোর দিয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। তাহার ছেঁড়া রুক্ষ চুলের গোছা দু-এক গাছা সর্বজয়ার হাতে থাকিয়া গেল।

অপু খাইতে খাইতে অবাক হইয়া সমস্ত ব্যাপার দেখিতেছিল। দিদি পুতির মালা চুরি করিয়া আনিয়াছিল। কিনা তাহা সে জানে না-পুতির মালাটা সে ইহার আগে কোনও দিন দেখে নাই—কিন্তু আমের গুটি যে চুরির জিনিস নয় তাহা সে নিজে জানে। কাল বৈকালে দিদি তাহাকে সঙ্গে করিয়া টুলুদের বাগানে আম কুড়াইতে গিয়াছিল এবং সোণামুখীর তলায় আম কটা পড়িয়া ছিল, দিদি কুড়াইয়া লইল, সে জানে কাল হইতে অনেকবার দিদি বলিয়াছে—ও অপু, এবার সেই আমের গুটিগুলো জারাবো, কেমন তো? কিন্তু মা অসুবিধাজনকভাবে বাড়ি উপস্থিত থাকার দরুন উক্ত প্রস্তাব আর কার্যে পরিণত করা সম্ভব হয় নাই। দিদির অত্যন্ত আশার জিনিস আমগুলো এভাবে লইয়া গেল, তাহার উপর আবার দিদি এরূপ ভাবে মারও খাইল। দিদির চুল ছিড়িয়া দেওয়ায় মায়ের উপর তাহার অত্যন্ত রাগ হইল। যখন তাহার দিদির মাথার সামনে রুক্ষ চুলের এক গোছা খাড়া হইয়া বাতাসে উড়ে তখনই কি জানি কেন, দিদির উপর অত্যন্ত মমতা হয়—কেমন যেন মনে হয় দিদির কেহ কোথাও নাই—সে যেন একা কোথা হইতে আসিয়াছে—উহার সাখী কেহ এখানে নাই। কেবলই মনে হয়, কেমন করিয়া সে দিদির সকল দুঃখ ঘুচাইয়া দিবে—সকল অভাব পূরণ করিয়া তুলিবে! তাহার দিদিকে সে এতটুকু কষ্টে পড়িতে দিবে না।