পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
পথের পাঁচালী
পথের পাঁচালী

ছিল? দুপুর বেলা দিদি কি খাইল? সে কি আবার কোন জিনিস চুরি করিয়া আনিয়াছে? কিন্তু ভয়ে কোনো কথা না বলিয়া সে কলের পুতুলের মতো মায়ের কথামতো কাজ করিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিল। পরে ভয়ে ভয়ে প্ৰদীপ উসকাইয়া দিয়া নিজের ছোট বইয়ের দপ্তরটি বাহির করিয়া পড়িতে বসিল। সে পড়ে মােটে তৃতীয় ভাগ-কিন্তু তাহার দপ্তরে দুখানা মোটা মোটা ভারী ইংরাজি কি বই, কবিরাজি ঔষধের তালিকা, একখানা পাতা-ছেড়া দাশুরায়ের পাঁচালি, একখানা ১৩০৩ সালের পুরাতন পাঁজি প্রভৃতি আছে। সে নানাস্থান হইতে চাহিয়া এগুলি জোগাড় করিয়াছে এবং এগুলি না পড়িতে পারিলেও রোজ একবার করিয়া খুলিয়া দেখে।

খানিকক্ষণ দেওয়ালের দিকে চাহিয়া সে কি ভাবিল। পরে আর একবার প্রদীপ উসকাইয়া দিয়া পাতা-ছেড়া দাশুরায়ের পাঁচালিখানা খুলিয়া অন্যমনস্কভাবে পাতা উলটাইতেছে, এমন সময়ে সর্বজয়া এক বাটি দুধ হাতে করিয়া ঢুকিয়া বলিল–এসো, খেয়ে নাও দিকি!

অপু দ্বিরুক্তি না করিয়া বাটি উঠাইয়া লইয়া দুধ চুমুক দিয়া খাইতে লাগিল। অন্যদিন হইলে এত সহজে দুধ খাইতে তাহাকে রাজি করানো খুব কঠিন হইত। একটুখানি মাত্র খাইয়া সে বাটি মুখ হইতে নামাইল। সর্বজয়া বলিল–ওকি? নাও সবটুকু খেয়ে ফেলো–ওইটুকু দুধ ফেললে তবে বাঁচবে কি খেয়ে–

অপু বিনা প্রতিবাদে দুধের বাটি পুনরায় মুখে উঠাইল। সর্বজয়া দেখিল সে মুখে বাটি ধরিয়া রহিয়াছে কিন্তু চুমুক দিতেছে না।–তাহার বাটিসুদ্ধ হাতটা কাঁপিতেছে. পরে অনেকক্ষণ মুখে ধরিয়া রাখিয়া হঠাৎ বাটি নামাইয়া সে মায়ের দিকে চাহিয়া ভয়ে কাঁদিয়া উঠিল। সর্বজয়া আশ্চর্য হইয়া বলিল–কি হল রে? কি হয়েচে, জিভ কামড়ে ফেলেছিস?

অপু মায়ের কথা শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ের বাঁধ না মানিয়া ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল–দিদির জন্য বড্ড মন কেমন করছে!..

সর্বজয়া অল্পক্ষণ মাত্ৰ চুপ করিয়া বসিয়া পরে সরিয়া আসিয়া ছেলের গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে শান্তসুরে বলিতে লাগিল–কেন্দো না, অমন করে কেন্দো না,-ওই পটলিদের কি নেড়াদের বাড়ি বসে আছে–কোথায় যাবে অন্ধকারে? কম দুষ্ট মেয়ে নাকি? সেই দুপুর বেলা বেরুল–সমস্ত দিনের মধ্যে আর চুলের টিকি দেখা গেল না–না খাওয়া, না দাওয়া, কোথায় ও-পাড়ার পালিতদের বাগানে বসে ছিল, সেখানে বসে কাঁচা আমি আর জামরুল খেয়েচে, এক্ষুনি ডাকতে পাঠাচ্ছি–কেন্দো না আমন করে–আবার জ্বর আসবে।–ছিঃ!

পরে সে আঁচল দিয়া ছেলের চোখের জল মুছইয়া দিয়া বাকি দুধ টুকু খাওয়াইবার জন্য বাটি তাহার মুখে তুলিয়া ধরিল-হাঁ করো দিকি, লক্ষ্মী সোনা, উনি এলেই ডেকে আনবেন এখন—একেবারে পাগল–কোথেকে একটা পাগল এসে জন্মেছে—আর এক চুমুক–হ্যাঁ–

রাত অনেক হইয়াছে। উত্তরের ঘরে তক্তাপোশে অপু ও দুর্গ শুইয়া আছে। অপুর পাশে