পাতা:পদাবলী-মাধুর্য্য.djvu/১১২

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১০৬
পদাবলী-মাধুর্য্য

জাল তৈরী করিয়াছেন। বিদ্যাপতির একজন প্রসিদ্ধ ভক্ত ও টীকাকার লিখিয়াছেন “চরণনখর মণিরঞ্জন” অর্থ নখ-রঞ্জিনী বা নরুণ। কৃষ্ণ ও নরুণ, উভয়ের বর্ণই কালো, সুতরাং পদটির অর্থ হইল যে, গোকুলচন্দ্র কৃষ্ণ একটা নরুণের মত ভূতলে পড়িয়া আছেন। এই উপমার আর একটি সার্থকতা এই যে, নরুণ দিয়া পায়ের নখ কাটা হয়। গোকুলচন্দ্রও রাধার পায়ের কাছেই পড়িয়া আছেন। বিদ্যাপতির মত এত বড় কবির তাঁহার একজন ভক্তের কৃত এরূপ নরসুন্দরী টীকার লাঞ্ছনা আমি কল্পনা করিতে পারিতাম না। পদটি কোন কোন সংস্করণে এইভাবে লিখিত হইয়াছে:—“চরণ-নখর-মণি-রঞ্জন ছাঁদ” এইভাবে লিখিত হইলে উহাকে টানিয়া বনিয়া কতকটা পূর্ব্বোক্ত ব্যাখ্যার পরিপোষক করা যাইতে পারে; তথাপি “নখরঞ্জিনী” না হয় নরুণ হইল, কিন্তু “নখরমণিরঞ্জিনী” যে নরুণ হইবে, ইহাও নিতান্ত কষ্ট-কল্পনা না করিলে সিদ্ধ হয় না। বিশেষতঃ মানুষের পায়ের নখকে নখর বলে না, বাঙালায় নখর বলিতে পশু-পক্ষীর নখ বুঝায়—মিথিলায় কি বুঝায় বলিতে পারি না। কিন্তু এই নরুণের উপমা অন্যদিক্‌ দিয়া সমর্থিত হইলেও, কবিত্বের দিক্ দিয়া উহা একবারে মারাত্মক। পদটী এইভাবে লিখিত হওয়া উচিত “চরণ-নখ রমণীরঞ্জন ছাঁদ” এবং ইহার অর্থ—এই যাহার পদনখের দ্যূতি, রমণীর মনোরঞ্জন করে, সেই শ্যামচন্দ্র রাধিকার পাদমূলে লুটাইয়া পড়িলেন। এই উক্তি-দ্বারা একদিকে শ্রীকৃষ্ণের রমণী-মন আকর্ষণ করিবার অসামান্য শক্তির ইঙ্গিত করা হইয়াছে, (সেই কৃষ্ণ যাঁহার পদ-নখ দ্যুতিতেই রমণী মুগ্ধ হয়), অপর দিকে তিনি রাধার পায়ের কাছে ভূতলে লুটাইয়া পড়িলেন—এই উক্তি দ্বারা তাঁহার গৌরবের সম্পূর্ণ ধ্বংস ও নতি স্বীকারের পরাকাষ্ঠা ‍তুলনায় প্রদর্শিত হইয়াছে।