পাতা:পদাবলী-মাধুর্য্য.djvu/১২৪

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১১৮
পদাবলী-মাধুর্য্য

 যে দেশে শীতে জল জমিয়া বরফ হইয়া যায়, সেখানকার হাওয়া বাঙালা দেশে আসিয়া লাগাতে অশ্রু শুকাইয়া গিয়াছে। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকে এখন চক্ষের জলের মূল্য স্বীকার করেন না। প্রেম-স্নেহ প্রভৃতি কোমল ভাবের সর্ব্বপ্রধান নিদর্শন এই অশ্রুর মূল্য স্বীকার করিতে হইলে নিগৃহীত পিতামাতার ও উপেক্ষিতা স্ত্রীর ঋণ স্বীকার করিতে হয়, শিক্ষিত সংজ্ঞায় অভিহিত দুর্নীত পুত্র ও স্বামীর তাহা হইলে খামখেয়ালী করায় বাঁধা জন্মে। অন্য দেশের কি তাহা জানি না, কিন্তু এই অশ্রুই বঙ্গদেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ্‌। চৈতন্য বক্তৃতা করেন নাই—উপদেশ দেন নাই—ধর্ম্মপ্রচার করেন নাই। তিনি চোখের জল দিয়া সমস্ত দেশটা বিজয় করিয়াছিলেন। তাঁহার একবিন্দু অশ্রুতে যে প্লাবন আনাইয়াছিল, তাহা এখনও সমস্ত নগর ও পল্লী ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে। বড় ব্যথা—বড় আনন্দের ক্ষেত্রে এই অশ্রুর জন্ম, ইহা এখন Sentimentalism-এর লক্ষণ বলিয়া যাঁহারা অগ্রাহ্য করিতে চান, তাঁহাদের মত কাটখোট্টা পণ্ডিত ইতিপূর্ব্বেও এদেশে অনেক ছিল। পাঁচ শত বৎসর পূর্ব্বে একদা শ্রীবাস গীতার আলোচনা-সভায় কাঁদিতেছিলেন, এইজন্য সে-সভার পণ্ডিতেরা তাঁহাকে গলাধাক্কা দিয়া তাড়াইয়া দিয়াছিল এবং স্বয়ং চৈতন্যদেবও বাসুদেব সার্ব্বভৌমের নিকট “ভাবুক” বলিয়া ভর্ৎসিত হইয়াছিলেন ও কাশীর প্রকাশানন্দ স্বামীও চৈতন্যকে ইহার জন্য নিন্দা করিয়াছিলেন। কিন্তু সমস্ত পণ্ডিতকে মূঢ় প্রতিপন্ন করিয়া চৈতন্যের দুইটি চক্ষুর মুক্তাসম অশ্রু কোটী কোটী লোকের মহাশাস্ত্র হইয়া আছে। এই পরমানন্দজ অশ্রুর কথাই কবি এখানে বলিতেছেন—

‘‘দুটি আঁখি ছল ছল,   চরণ-কমলতল,
  কানু আসি পড়ল লুটাই।’’