পাতা:পদাবলী-মাধুর্য্য.djvu/৩৮

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৩২
পদাবলী-মাধুর্য্য

শুধু চৈতন্য-দেবে পাই। যখন উহা আসে, তখন ভাঙ্গিয়া চুরিয়া আসে, সমস্ত বাধা চূর্ণ করিয়া গঙ্গার মত সগৌরবে বিজয়-বার্ত্তা ঘোষণা করিতে করিতে আসে।

 এখানে একটা অবান্তর কথা বলিব। বৌদ্ধ-ধর্ম্ম অত্যন্ত দুঃখ-নিবৃত্তির জন্য ইন্দ্রিয়গুলিকে একেবারে নির্ম্মূল করিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু বৈষ্ণবেরা বলেন, জগতের কিছুই মিথ্যা বা অব্যবহার্য্য নহে। এই ইন্দ্রিয়গুলির যে দুর্দ্দমনীয় শক্তি, তাহা ভগবানের মন্দিরে পৌঁছাইবার প্রকৃষ্ট পন্থা, এ জগতের খড়-কুটো সকলটা দিয়াই বিশ্বের প্রয়োজন আছে। রাধিকা ইন্দ্রিয়ের দুর্দ্দমনীয় স্রোতঃ দিয়া সেই পথে যাইতেছেন, যে পথে দিয়া গেলে ডিঙ্গি “অন্তিমে লাগিবে গিয়া ত্রিদিবের ঘাটে।”

 আমি বৈষ্ণব-কবিতা প্রসঙ্গে একস্থানে লিখিয়াছিলাম—এই পদাবলী যেন সমুদ্র-মুখী নদীর স্রোত:—দুই কুলে মনুষ্য-বসতি, ভ্রমরগুঞ্জিত পুষ্পবন, হাটের কলরব, পথিকের রহস্যালাপ, গোচারণের মাঠ, শিশুর কাকলী-মুখরিত মাতৃ-অঙ্গন, সখাদের খেলাধূলা,—নদীর যাত্রাপথের দুই দিকে কত দৃশ্য—কত মন্দানিলচালিত, কেতকীকুন্দ-গন্ধামোদিত উপবন, কত সোণার ফলসে হাস্যময় দিগ্বলয়ে দিগ্বধুদের অঞ্চললীলা। পার্থিব সকল দৃশ্যই দু’কূলে দেখিতে দেখিতে নৌকার পান্থ চলিতে থাকিবেন। কিন্তু যখন মোহনায় পৌঁছিবেন, তখন দেখিবেন, দূরে অকুল-প্রসারিত অনন্ত সাগর, সেখানে সমস্ত কলকোলাহল থামিয়া গিয়াছে, সেখানে জগতের সমস্ত রহস্যের নির্ব্বাক্‌ ধ্যানমূর্ত্তি। বৈষ্ণবকবিরা জগতের কোন কথাই বাদ দেন নাই, কিন্তু সকল কথার সঙ্গেই পরমার্থ-কথার যোগ রাখিয়াছেন; এই সাহিত্য-ধারার সর্ব্বত্রই সমুদ্রের হাওয়া খেলে, এখানে মোহনা বন্ধ হইয়া নদী বিলে পরিনত হয় নাই;