পাতা:প্রবন্ধ সংগ্রহ - প্রমথ চৌধুরী.pdf/১১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SOS প্ৰবন্ধসংগ্ৰহ করে থাকেন। সতরাং আমরা কোনো সন্ট পদার্থের বিষয় দশো হাত তত্ত্বজাল বনতে সাহসী হই নে, অন্তত কোনো কাব্যরত্নকে সে জালে জড়াতে চাই নে। কাব্যের আগমনের পরিচয় দেবার জন্য তাকে সমালোচনার ছাইচাপা দেওয়াটা সবিবেচনার কায নয়, কেননা সে গণের পরিচায়ক হচ্ছে অনভূতি। এ যাগের রচনার নাতিদীঘতা এই সত্যেরই প্রমাণ দেয় যে, একালের লেখকেরা পাঠকদের মান্য করতে শিখেছেন। হিন্দপথানিরা বলেন যে, “আক্কেলিকো ইসারা বাসা’। যাঁদের শ্রোতার আক্কেলের উপর কোনো আস্থা নেই, তাঁরাই একটখানি কথাকে ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে ফলিয়ে অনেকখানি করে তুলতে ব্যস্ত। সমালোচকদের মতে বতমানের আর-একটি অপরাধ এই যে, এ যাগে এমন কোনো লেখক জন্মগ্রহণ করেন নি, যাঁর প্রতিভায় দেশ। উক্তজবল করে রেখেছে। এ আমাদের দভাগ্য, দোষ নয় ; প্রতিভার জন্মের রহস্য কোনো দার্শনিক কি বৈজ্ঞানিক অদ্যাবধি উদঘাটন করতে পারেন নি। তবে এটাকু আমরা জানি যে, প্রতিভার পণে বিকাশের জন্য পারিপাশিবক অবস্থার আনকল্য চাই। এ কথা যদি সত্য হয় তা হলে স্বীকার করতেই হবে যে, নন্তন সাহিত্য গড়বার যে সংযোগ গত শতাব্দীর লেখকেরা পেয়েছিলেন, সে সযোগ আমরা অনেকটা হারিয়েছি। গত যাগের লেখকেরা সবাই প্রধান না হোন, সবাই স্বাধীন ছিলেন। তৎপাবযাগের বঙ্গ সাহিত্যের চাপের ভিতর থেকে তাঁদের তোড়ে-ফাঁড়ে বেরতে হয় নি। একটি সম্পৰ্ণে নতন এবং প্রভূত ঐশ্ববর্য ও অপব সৌন্দৰ্য-শালী সাহিত্যের সংস্পশেই উনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গ সাহিত্য জন্মলাভ করে। সে সাহিত্যের উপর প্রাক-ব্রিটিশ যাগের বঙ্গ সাহিত্যের কোনোরপে প্ৰভুত্ব ছিল না। অন্নদামঙ্গলের ভাষা ও ছন্দের কোনোরাপ খাতির রাখলে মাইকেল মেঘনাদবধ রচনা করতেন না, এবং বিদ্যাসন্দরের প্রণয়কাহিনীর কোনোরাপ খাতির রাখলে বঙ্কিমচন্দ্ৰ দাগেশনন্দিনী রচনা করতেন না। মিলটন এবং সঙ্কট যাঁদের গর, তাঁদের কাছে ভারতচন্দ্রের ঘোষবার অধিকার ছিল না। কিন্তু আজকের দিনে ইংরেজি সাহিত্য আমাদের কাছে এতটা পরিচিত এবং গা-সওয়া হয়ে এসেছে যে, তার থেকে আমরা আর বিশেষ কোনো নািতন উদ্দীপনা কিংবা উত্তেজনা লাভ করি নে। আমাদের মনে ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম পরিচয়ের চমক ভেঙেছে, কিন্তু বিশেষ পরিচয়ের প্রভাব স্থান পায় নি। সতরাং আমরা গত যাগের সাহিত্যেরই জের টেনে আসছি। আমাদের পক্ষে তাই নতুন কিছু করা একরকম অসম্পভব বললেও অত্যুত্তি হয় না। প্রতিভাশালী লেখকের সাক্ষাৎ আমরা সেই যাগে পাই, যে যাগে একটা নতেন এবং প্রবল ভাবের প্রবাহ হয়। ভিতর থেকে ওঠে নয় বাইরে থেকে আসে। গত যাগে যে ভাবের জোয়ার বাইরে থেকে এসেছিল, এ যাগে তার তোড় এত কমে এসেছে যে, ভাটা শীর হয়েছে বলা যেতে পারে। এদিকে ভিতর থেকেও একটা নতেন কোনো ভাবের উৎস খালে যায় নি। বরং সমাজের মনের টান আজ পর্যাতনের দিকে, এও তো ভাবের প্রবাহের ভাটার অন্যতম লক্ষণ। এই ভাটার মাখে নতুন কিছ করতে হলে কালের স্রোতে উজান বইতে হয়। তা করা সহজ নয়। এ অবস্থায় যা করা সহজ তা হচ্ছে সনাতন জ্যাঠাম।।