পাতা:প্রবন্ধ সংগ্রহ - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৪৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিষার কথা আমি যদি কবি হাতুম, তা হলে আর যে বিষয়েই হোক, বর্ষার সম্পবন্ধে কখনো কবিতা লিখতুম না। কেন ? তার কারণগলি ক্ৰমান্বয়ে উল্লেখ করছি। প্রথমত, কবিতা হচ্ছে আর্ট। পাশ্চাত্য পন্ডিতদের মতে আর্ট-জিনিসটি দেশকালের বাঁহভূত। এ মতের সার্থকতা তাঁরা উদাহরণের সাহায্যে প্রমাণ করতে চান। হ্যামলেট, তাঁদের মতে, কালেতে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে না, এবং তার জন্মস্থানেও তাকে আবদ্ধ করে রাখবার জো নেই। কিন্তু সংগীতের উদাহরণ থেকে দেখানো যেতে পারে যে, এ দেশে আর্ট কালের সম্পৰ্ণ অধীন। প্রতি রাগরাগিণীর স্ফতির ঋতু মাস দিন ক্ষণ নিদিষ্ট আছে। যাঁর সরের দৌড় শািন্ধ ঋষভ পৰ্যন্ত পৌছায় তিনিও জানেন যে, ভৈরবীর সময় হচ্ছে সকাল আর পরবীর বিকাল। যেহেতু কবিতা গান থেকেই উৎপন্ন হয়েছে, সে কারণ সাহিত্যে সময়োচিত কবিতা লেখবারও ব্যবস্থা আছে। মাসিকপত্রে পয়লা বৈশাখে নববর্ষের কবিতা, পয়লা আষাঢ়ে। বর্ষার, পয়লা আশিবনে পাজার, আর পয়লা ফালগনে প্রেমের কবিতা বেরোনো চাইই চাই। এই কারণে আমার পক্ষে বর্ষার কবিতা লেখা অসম্পভব। যে কবিতা আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে প্রকাশিত হবে, তা অন্তত জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি রচনা করতে হবে। আমার মনে কলপনার এত বাক্ষপ নেই যা নিদাঘের মধ্যাহ্নকে মেঘাচ্ছন্ন করে তুলতে পারে। তা ছাড়া, যখন বাইরে অহরহ আগনি জবলছে তখন মনে বিরহের আগনি জবালিয়ে রাখতে কালিদাসের যক্ষও সক্ষম হতেন। কি না সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। আর বিরহ বাদ দিয়ে বর্ষার কাব্য লেখাও যা হ্যামলেটকে বাদ দিয়ে হ্যামলেট নাটক লেখাও তাই। দ্বিতীয়ত, বর্ষার কবিতা লিখতে আমার ভরসা হয় না। এই কারণে যে, এক ভরসা ছাড়া বরষা আর-কোনো শব্দের সঙ্গে মেলে না। বাংলা কবিতায় মিল চাই, এ ধারণা আমার আজও যে আছে। এ কথা আমি অস্বীকার করতে পারি নে। যখন ভাবের সঙ্গে ভাব না মিললে কবিতা হয় না, তখন কথার সঙ্গে কথা মিললে কেন যে তা কবিতা না হয়ে পদ্য হবে, তা আমি বঝতে পারি নে। তা ছাড়া, বাস্তবজীবনে যখন আমাদের কোনো কথাই মেলে না, তখন অন্তত একটা জায়গা থাকা চাই যেখানে তা মিলবে, এবং সে দেশ হচ্ছে কলপনার রাজ্য, অর্থাৎ কবিতার জন্মভূমি। আর-এক কথা, অমিত্ৰাক্ষরের কবিতা যদি শ্রাবণের নদীর মতো দকল ছাপিয়ে না বয়ে যায়, তা হলে তা নিতান্ত অচল হয়ে পড়ে। মিল অর্থাৎ অন্তঃঅন্যপ্রাস বাদ দিয়ে পদাকে হিল্লোলে ও কল্লোলে ভরপর করে তুলতে হলে মধ্যঅন্যপ্রাসের ঘনঘটা আবশ্যক। সে কবিতার সঙ্গে সততাস"gরমান নবজলধরপটলের সংযোগ করিয়ে দিতে হয়, এবং তার চলোমির গতি যাদঃপতিরোধ ব্যতীত অন্য কোনোরাপ রোধ মানে না। আমার সরস্বতী হচ্ছেন প্রাচীন সরস্বতী, শঙ্কা না। হলেও ক্ষীণা; দামোদর নন যে, শব্দের বন্যায় বাংলার সকল ছাঁদবাঁধ ভেঙে বেরিয়ে