পাতা:প্রবন্ধ সংগ্রহ - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যািসন্মিলন গত সাহিত্যসম্মিলনে একটি নতন সরের পরিচয় পাওয়া গেছে- সে হচেছ সত্যের সাের। এ সরে যে বঙ্গ সাহিত্যে পাবে কখনো শোনা যায় নি, তা নয়। তবে নতনত্বের মধ্যে এইটকু যে, আর-পাঁচটি বিবাদী সংবাদী ও অন্যবাদী সদরের মধ্যে এবারকার পালায় এইটিই ছিল স্থায়ী সর। এবং সে সরে যে অতি সংস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, তার কারণ তা কোমল নয়, তীব্র। এবারকার ব্যাপারের কমকতারা নিমন্ত্ৰিত অভ্যাগত সাহিত্যিকদের প্রচলিত প্রথামত ‘আসন বসন’ বলে সম্ভাষণ করেন নি, "উঠনে চলন’ বলে অভিভাষণ করেছেন। এরা সকলেই গলার আওয়াজ আধসর চড়িয়ে মন্তকণ্ঠে একবাক্যে বলেছেন যে, “এ দেশের সেকাল সত্যযাগ হতে পারে, কিন্তু একাল হচ্ছে মিথ্যার যােগ।” এই দেশব্যাপী মিথ্যার হােত হতে কি করে উদ্ধার পাওয়া যায়, তারই সন্ধান বলে দেওয়াটাই ছিল সাহিত্যাচাৰ্যদের মােখ্য উদ্দেশ্য। মিথ্যার চাচা লোকে দভাবে করে- এক জেনে, আর-এক না জেনে। সত্য যে কি, তা জেনেও কেউ কেউ কথা ও কাজে তা নিত্য উপেক্ষা করেন। এ রোগের ঔষধ কি, বলা কঠিন ; অন্তত ওর কোনো টোটকা আমার জানা নেই। অপর পক্ষে, অনেকে কেবলমাত্র মানসিক জড়তাবশত ও-বস্তু যে কি তার সন্ধান জানেনও না, নেনও না। তাই সম্মিলনের মািখপাত্রেরা, যাদের মনের সবৰ্ণাণ্ডেগ আলস্য ধরেছে সেই শ্রেণীর লোকদের, উপদেশ দিয়েছেন- “উত্তিস্ঠত জাগ্রত’। এরা আমাদের জাগিয়ে তুলতে চান সত্যের জ্ঞানে, আমাদের উঠে চলতে বলেন সত্যের অন্যাসন্ধানে। কারণ, যে সত্য চােখের সমখে রয়েছে সেটিকে দেখাও আমাদের পক্ষে যেমন কতব্য, যে সত্য লকিয়ে আছে তাকে খাঁজে বার করাও আমাদের পক্ষে তেমনি কতব্য। কোনো জিনিস দেখতে হলে জাগা অৰ্থাৎ চোখ খোলা দরকার, আর কোনো জিনিস খাজতে হলে ওঠা এবং চলা দরকার। তাই এরা আমাদের “উত্তিস্ঠত জাগ্রত’ এই মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চান। তবে আমরা এ মন্ত্রে দীক্ষিত হতে রাজি হব কি না জানি নে ; কেননা এ মন্মের সাধনায় আমরা অভ্যস্ত নই। লোকপ্ৰবাদ যে, পরতে যখন মন্তর পড়ে পাঁঠা। তাতে কৰ্ণপাত করে না। পঠিা যে ও-সব কথা কানে তোলে না। তার কারণ, উৎসগের মন্ত্র পড়া হয়। ছাগকে বলি দেবার জন্য। কিন্তু এই সাহিত্যাযজ্ঞের পরোহিতেরা যে মন্ত্র পড়েছেন তা বলির মন্ত্র নয়, বোধনের মন্ত্র। সতরাং তাতে কণপাত করায় আমাদের বিশেষ আপত্তি হওয়া উচিত নয়। আমরা মানি আর না মানি, এরা যে-কথা বলেছেন তা যে মন দিয়ে শোনবার মতো কথা, এই বিশবাসে আমি সাহিত্যািসন্মিলনের অভিভাষণচতুর্টয়ের আলোচনা করতে প্ৰবন্ত হয়েছি।