পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শ্ৰীঅবিনাশচন্দ্র বসু সহাদ্রির উপরে একটি নিৰ্ম্মল শীতের দিনের স্মৃতি আমার মনে চিরদিন উজ্জল হইয়া থাকিবে। এক দেশী রাজ্যের রাজধানীর উপকণ্ঠে, রাজার বাগানবাড়িতে, এক জন মহারাষ্ট্রীয় বন্ধুর সহিত আমি রাজ-অতিথিরূপে বাস করিতেছিলাম। প্রতিদিনের মত সেদিনও প্রত্যুষে গাত্ৰোখান করিলাম। ঋতু অনুসারে ভর-শীত, কিন্তু বাংলার অগ্রহায়ণের প্রথম ভাগের মত অতি সামান্য শৈত্য। গাছের পাতায় পাতায়, তৃণগুল্মে শিশিরকণা ছড়াইয় আছে। স্বচ্ছ নীল আকাশের উপর কুয়াশার ক্ষীণ আবরণ, পূৰ্ব্বাকাশে উষার মৃদ্ধ দীপ্তি। তাহার নীচে মাথা তুলিয়া ধূসর পাহাড়শ্রেণী দাড়াইয়া। মধ্যে হুদূর বিস্তৃত উপত্যক স্থানে স্থানে তরঙ্গায়িত হইয়া উঠিয়াছে। নিম্নভূমিতে খৰ্ব্বকায় বৃক্ষসকল দল বাধিয়া রহিয়াছে। সমস্ত আকাশ বাতাস একটা অপরিসীম নিৰ্ম্মলতায় ভরিয়া গিয়াছে। সে নিৰ্ম্মলতা মনে করাইয়া দেয় সদ্য-ফুট পুপরাজির কথা, সদ্যোজাত তৃণাস্কুরের কথা, শিশুর উচ্ছসিত হাসির কথা, নিষ্কলুষহৃদয়া কুমারীর শুভ্ৰ মুখমণ্ডলের কথা । মনে হয়, যেন কিশোরী ধরিত্রী ব্ৰতশুদ্ধ চিত্তে ধ্যানস্থ হইয়া আছে । ধীরে ধীরে প্রত্যুষের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া চারিদিক হইতে কলরব উঠতে লাগিল । প্রথম উঠিল পার্থীর কাকলি। কিছুক্ষণ পরে তাহা অতিক্রম করিয়া উচ্চৈঃস্বরে ধ্বনিয়া উঠিল কৃষক বালক-বালিকাগণের কোমল কণ্ঠের চীৎকার। তাহারা জোয়ারী খেতের মাচানে দাড়াইয়া পার্থী তাড়াইতেছে। - ধীরে ধীরে দিগন্তের কুয়াশার আবরণ কাটিয়া গেল। পাহাড়ের প্রতি চুড়া উদ্ভাসিত করিয়া তরুণ স্বৰ্য্য উদিত হইল। দেখিতে দেখিতে উজ্জল স্বৰ্য্যকিরণ সমস্ত উপত্যকায় ছড়াইয়া পড়িল । সে-কিরণের স্পর্শে যেন প্রতি জীবের শিরায় শিরায় লোহিত রক্ত নৃত্য করিয়া উঠিল। মেষের দল রাখালদের নির্দেশ অমান্ত করিয়া সারা মাঠময় ছড়াইয়া পড়িল । মহিষের বাছুরগুলি দুরন্তভাবে ছুটাছুটি করিতে লাগিল । বাকে ঝাকে বনচড়ুইরা জোয়ারী ক্ষেতে গিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল, সেখানে তাড়া খাইয়া সোনালী রোদে পাখা মেলিয়৷ গা ভাসাইয়া দিল । শিশুকণ্ঠের কোলাহলের মধ্যে যেন একটা অদম্য উল্লাস ফুটিয়া উঠিতেছিল। আমাদের বাগানবাড়িটা একটা পাহাড়ের ঢালুতে। উপর হইতে চওড়া রাস্ত আসিয়া নামিয়াছে। তাহা আমাদের বাড়ির সন্মুখ দিয়া ক্রমশ নীচের দিকে গিয়া কিছু দূরে একটা ঝরণা অতিক্রম করিয়া আবার পাহাড়ের উপরে উঠিয়াছে। যতদূর দেখা যায় সোজা চলিয়াছে এবং সৰ্ব্বশেষে পাহাড়ের চুড়ায় গিয়া অদৃগু হইয়াছে। স্বৰ্য্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সে রাস্ত দিয়া দু-চার জন করিয়া স্ত্রীপুরুষ যাতায়াত করিতে মুরু করিল। শহরের বাহিরে বলিয়া সে রাস্তায় লোকচলাচল কম । সহসা পাহাড়ের উপরের দিকটায় বহু অশ্বের ক্ষুরধ্বনি শোনা গেল। দেখিতে দেখিতে উপর হইতে এক দল অশ্বারোহী লোক ছুটিয়া আসিল । তাহাদের গায়ে লাল কোর্তা, মাথায় গাঢ় নীল পাগড়ী, পায়ে থাকি রঙের পট্টি জড়ানো। তাহারা অগ্রসর হইলে, অশ্বের ক্ষুরধ্বনি ডুবাইয়া দিয়া একটা ঝনৎকার উঠিল। দেখা গেল অশ্বারোহীদের পিছনে শ্রেণীবদ্ধভাবে এক দল শৃঙ্খলিত লোক আসিতেছে। তাহাদের হাতে হাতকড়া, পায়ে বেড়ী, বা হাত ও বা পায়ের মধ্যে লম্বা শিকল ঝোলানো। সে শিকলেরই ঝনঝন শব্দ হইতেছে। অধিকাংশ লোকই সবল, দীর্ঘাকৃতি। প্রথমদর্শনে মনে হয় যেন কোনও বিজয়ী বীর বিপক্ষ সেনাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া স্বরাজ্যে লইয়া যাইতেছে। অশ্বারোহীর দল আমাদের বাগানে প্রবেশ করিল, সদে সঙ্গে বন্দীর দলও আসিল । বাগানের এক পাশে গিয়া