পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কীৰ্ত্তিক অহেতুক আনন্দ সে যেন আর ধরিয়া রাখিতে পারিতেছিল না। কেমন একটু লজ্জাও করিতেছিল। যদি পরিবেশনকালে স্বামীর চোখে চোখ পড়িয়া যায়! অবগুণ্ঠনের ফঁাকে সে ত এক বার ন-চাহিয়াও পারিবে না। আর তপোনাথ যে ছেলে, সে ত ইচ্ছা করিয়া শুধু তাহাকে বিপদে ফেলিবার জন্যই চোখে চোখ ফেলিতে চেষ্টা করিবে । লজ্জা বলিয়া কিছু যদি তাহার থাকে ! ওদিকে সমস্ত সকাল তপোনাথ তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়া অগত্যা একাই পাশের বাড়িতে যে নূতন ভদ্রলোক আসিয়াছেন তাহার সঙ্গে পরিচয় করিবার জন্য বাহির হইল। অজীর্ণ-রোগগ্ৰস্ত বৃদ্ধ ভদ্রলোক। সৌম্য মূৰ্ত্তি। মাথার সম্মুখের দিকে টাক। পরনে ইংরেজী পোষাক। একটি ছড়ি হাতে সম্মুখের বাগানে পায়চারি করিতেছিলেন । তপোনাথকে পাইয়! তিনিও বাচিলেন, র্তাহার মেয়েও বাচিল । বুদ্ধ বয়সের যা রোগ, ভদ্রলোক একটু বেশী কথা বলেন। এক মেয়ের পক্ষে সকল কথায় মনোযোগ দেওয়া কম পরিশ্রমের ব্যাপার নয়। তপোনাথ আসিতেই পিতাকে তাহার কাছে গচ্ছিত রাখিয়া মেয়েটি ভিতরে চলিয়া গেল । মিঃ ডাট্‌ বলিলেন—আমার মেয়ে অনুভ । ওই একটি মাত্রই আমার সন্তান । তপোনাথ চাহিয়া দেখিল, বছর চব্বিশ-পচিশের একটি শীর্ণ মেয়ে। রংটি বেশ মাজ, গলায় সরু এক গাছি হার । হাতে দুই গাছি করিয়া সরু চুড়ি। পায়ে পাংলা চটি। মিঃ ডাট্‌ জোর করিয়া তাহাকে চা খাওয়াইলেন, এবং ঘণ্ট-দুই ধরিয়া অনর্গল কত কথাই বকিয় গেলেন। তপোনাথের যে প্রকার মানসিক অবস্থা তাহাতে কতক কানে গেল, কতক গেল না । ফিরিয়া আসিয়া স্নান সারিয়া সে আহারে বসিল । কিন্তু কথাও কহিল না । সবিতা যে এই প্রথম তাহাকে নিজের হাতে পরিবেশন করিয়া খাওয়াইতেছে তাহাও যেন চোখে পড়িল না । মা জিজ্ঞাসা করিলেন—খেয়ে ত যাচ্ছিস, রান্না কেমন ইয়েছে ? তপোনাথ যেন আকাশ হইতে পড়িল । মাথা নাড়িয়া বলিল—বেশ হয়েছে, মন্দ হয় নি। ১১ —বেশ হয়েছে, মন্দ হয়নি সে আবার কি রকম ? আর ছু-খানা কাটুলেট দেবে ? —ন, না, আর দরকার নেই । —একটু মাংস ? —কিছু চাই না। তপোনাথ আহারাস্তে শুইয়া পড়িল । প্রত্যাশা করিতে লাগিল, তাহার ক্রোধের কারণ বুঝিতে সবিতার নিশ্চয়ই বিলম্ব হয় নাই। এইবার সে অভিমান ভাঙাইতে আসিবে । তাহার চোখে আর ঘুম আসে না, কেবল এপাশ-ওপাশ করে । অভিমান ভাঙাইতেও বটে, কিন্তু তারও চেয়ে বেশী রান্না কেমন হইয়াছে তাহ নিজমুখে শুনিবার জন্য সবিতাও ভিতরে ভিতরে যথেষ্ট চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। তৰু পারিল না । বসিয়া বসিয়া অস্বস্থা শাশুড়ীর পায়ে হাত বুলাইতে লাগিল । ওঘরে তপোনাথ তখন ঘুমাইবার ব্যর্থ চেষ্টা করিয়৷ অবশেষে উঠিয়া বসিয়াছে। বেলা তখন দুইটার বেশী নয়, কিন্তু পড়ন্ত রৌদ্রের দিকে চাহিলে মনে হয় বেলা আর নাই । সম্মুখের পাহাড়ের গায়ে ছায়া আরও ঘন হইয়াছে। কিন্তু শালবনের মাথায় এখনও রৌদ্র বেশ চিকমিক করিতেছে। এদিকের জানালা দিয়া রেল-লাইন এবং ষ্টেশনের অনেকটা দেখা যায়। গুইয়া ওইয়া ষ্টেশনটা দেখিতে আশ্চৰ্য্য লাগে । যেন পটে অাকা ছবি। মাটির সঙ্গে যোগ নাই। ওখানে কে যেন টাঙাইয়া রাখিয়া গিয়াছে, যে-কোন মুহূৰ্ত্তে সরাইয়া লইয়া যাইতে পারে। কিছুমাত্র স্থায়িত্ব নাই। ট্রেনের পর ট্রেন আসে। ক্ষণকাল বিশ্রাম করে। যাত্রীর কোলাহলে সমস্ত ষ্টেশন চঞ্চল হইয় ওঠে। মনে হয় শুধু যাত্রী নয়, ষ্টেশনটমৃদ্ধ এই ট্রেনে কোনও অজ্ঞাত দূর দেশে চলিয়া যাইবে। পিছনে পড়িয়া থাকিবে শূন্ত মাঠ। কিন্তু ট্রেন চলিয়া যায়। বিষ্ণ ষ্টেশন শূন্ত মাঠে খ খ করে। যেন সঙ্গীরা তাহাকে এক ফেলিয়া লুকাইয়া পলাইয়া গেল, সঙ্গে লইয়া গেল না। কোন অজ্ঞাত সুদূরের তৃষ্ণায় তপোনাথের মনও হু হু করিয় ওঠে। মনে হয়, মিথ্যা অপরিচিতকে পরিচিত করার প্রয়াস, মিথ্যা স্নেহ মায়া মমতা, মিথ্যা মামুষের জন্য মানুষের দুৰ্দ্দমনীয় আকর্ষণ। আসে বটে, জীবনের তরুচ্ছায়ায় দুইটি