পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৫৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বর্তমান জীবন-সমস্যার ভারতীয় মীমাংসা ষ্ট্ৰীগঙ্গাপ্রসাদ শৰ্ম্ম মানুষ যেদিন তাহার জীবনের মহত্ত্বকে আবিষ্কার করিয়া তাহারই চির-বন্ধুর সাধনপথে প্রথম পদার্পণ করিল, সেইদিনই হইল সভ্যতার জন্মদিন। সভ্যতার স্বর্ণ-উষার উজ্জল আলোকে, বিপুল পুলকে মাতিয়া যে মহান যাত্রীদল অমৃতের সন্ধানে প্রথম এই মৃত্যুময় সংসারকে অতিক্রম করিয়া চলিল, তাহারাই হইল সভ্যতার প্রবর্তক বা অগ্রদূত। অনন্ত অসীম অজানাকে জানিবার, অচেনাকে চিনিবার মানবমনের যে অদম্য আগ্রহ—তাহাই ছিল সেই স্বেচ্ছায় গৃহহারা দলের একমাত্র পাথেয় । তাহাদের পায়ে পায়ে যে পথ রচিত হইল, তাহাই হুইল মনুষ্যত্বের সনাতন পন্থা। র্তাহাদের বাণীই মানবতার বোধনগায়ত্রী। চির-বিঘ্ন-মণ্ডিত এই মহত্ত্বের পথ। অথচ জাগ্রত মানবতার পক্ষে আকর্ষণ তার অলঙ্ঘনীয়। বুকে অগ্নিপ্লাবন বহিয়া ভীষণ ভৈরব জালার জয়গান গাহিতে গাহিতে যুগে যুগে মানবসন্তান চলিয়াছে এই মহিমারই কণ্টকিত পথে। ইতিহাস এই বেদনাময়ী গতিজালার স্মৃতি বহনে ধন্ত, কাব্য ও শিল্পের ইহাই প্রাণবস্তু, দর্শন বিজ্ঞান এই গতিতত্ত্ব-বিশ্লেষণেই সার্থক। বাহিরে উদ্বেলিত সংসারসমুদ্রের প্রলয়কল্পোলে এই গতিশীল আৰ্যদের ভয়বিবর্জিত গতিবেগ কিছুমাত্র সংযত হয় নাই। বস্তুজগতের কোন বাধা না মানিয়া বাহিরের সকল সঞ্চয় দুই হাতে ক্ষয় করিতে করিতে সেই আধুষ্য পথিকের দল পথের আনন্দবেগে চলিয়াছে অস্তর পূর্ণ করিয়া। অবশেষে একদিন পথের শেষে এই ব্যথার মধ্য হইতেই আপনার আনন্দ ও ঐশ্বৰ্য্যকে সম্যকরূপে আবিষ্কার করিয়াই তাহারা ধন্ত ও স্বরাটু হইয়াছে । মহিমার সেই দিব্যানন্দ সাধককে আর ফিরিতে দেয় নাই এই ক্ষুদ্রতার জগতে, লইয়া গিয়াছে র্তাহাকে তুচ্ছ সাংসারিক লাভক্ষতির সতর্ক হিসাব-নিকাশের বহু উদ্ধে, অক্ষয়, অব্যয়, শাশ্বত অমৃতলোকে, আনন্দ হইতে আননে, উৎসব হইতে উৎসবে। - সেদিন মানুষ শ্রমিক নয়, বণিক নয়, শাসক নয়, শাসিত নয়, প্রবৃত্তিমার্গের সেনি সে আর কেহই নয় ; সেদিন সে অকামহত শৰ্ম্মণ বা নিষ্কাম ব্রাহ্মণ। সেদিন প্রদানেই তার আনন্দ, আদানের কথা সে তুলিয়া যায়। সেই মহামানবের চরণম্পর্শে ধরণীর ধূলি নিজের মলিনতা ভুলিয়া যায়, স্বর্গ পৃথিবীতে নামিয়া আসে। মানবসমাজ তাহার চরণে চিরপ্রণত । এই ধন্যতাই সভ্যতার লক্ষ্য, মনুষ্যত্বের ভিত্তি। মুহূর্বে মুহূৰ্ত্তে বিমলন ও পদে পদে আত্মশাসনই আৰ্য্যের জীবন। এ-পথের ধাহা ক্ষয় ও লজ্জা, স্বসভ্য মানবের তাহাই সঞ্চয় ও সজ্জা । এই বেদনার তীর্থযাত্রায় অপ্রস্তুত যে, ক্ষুদ্রাশয় অনার্ষ্য লে। সভ্যতার দাবি তার পক্ষে নিরর্থক। তুষার-ধবল শৈল-শিখরে, মরুভূর ধূ-ধূ-ধূ বালুক বিস্তারে, উত্তাল তরঙ্গসঙ্কুল সমুদ্রবক্ষে, নিভৃত পল্লীর বনান্তরালে যে মহতো মহীয়ান পুরুষের মহিমাজ্যোতির নিত্যবিকাশ, স্বরূপতঃ মাকুয র্তাহারই উপাসক। সভ্যতার উন্নতি-অবনতি অর্থে মানুষের বিত্ত-সম্পদের হ্রাসবৃদ্ধি নহে, চিত্ত-সম্পদের প্রকাশ। যে-সভ্যতার অধীনে মনুষ্যজীবনের দায়িত্ব ও মহত্ব বোধ যত প্রখরতা লাভ করিয়াছে, সেই সভ্যতা তত গরীয়সী। যেখানে উহার অভাব সেখানে সভ্যতার গৌরব নাই একথা অসঙ্কোচে বলা যাইতে পারে। ভাব ও বস্তুর সমাহারেই মহুষ্যজীবনের স্বাস্থ্য ও পূর্ণতা। তবে জীবনের সম্প্রসারণের জন্য উহার বাস্তব দিকটা ভাবানুগ হওয়া অত্যাবস্তক। অতি-বাস্তবতার ফলে বর্তমান সভ্যতার অধীনে মনুষ্যত্বের দৈন্ত আজ সকল দিক দিয়াই ফুটতর হইয়া পড়িয়াছে। আজ আর এই অভিব্যক্ত দৈন্তকে কোনক্রমেই অস্বীকার করিবার উপায় নাই। যেখানে যত জোরে ইহাকে অস্বীকার করিবার চেষ্ট হইতেছে, সেখানে ততোধিক শক্তিতে ইহা আত্মপ্রকাশ করিতেছে। আধিপত্য ও ঐশ্বর্ঘ্যের সন্নিপাতে মনের প্রকৃতিতে যে মহাবিকার উৎপন্ন হুইয়াছে, তাহার প্রভাবে মানরহৃদয়ের মঙ্গলময়ী বৃত্তিগুলি একেবারে নিজীব হইয়া পড়ায়ই সৰ্ব্বত্র পশুত্বের জাগরণ সম্ভব হইয়াছে। বিষয়ের ধূলিজালে মানবতার, মহিমাজ্যোতি ক্রমশ মানতর হইয়া যাইতেছে। বস্তু-স্তুপের নীচে পীড়িত মানবাত্মার ক্ষীণ আৰ্ত্তনাদ শোনা যাইতেছে। সে আর্তনাদ শুনিবার